শিক্ষার্থীদের মন পুনরায় জয় কি করতে পারবে সরকার?

সত্যিকারের পরিবর্তন আসতেই হবে—সরকার সত্যিই এ বার্তাটি গ্রহণ করেছে কিনা তা জানতে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষায় সবাই। এর আগেও আমরা অনেকবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। তবে আজকের মতো তা কখনোই এতটা জরুরি হয়ে পড়েনি। সরকার অতীতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার পেয়ে গেলেও, তার বাস্তব রূপ কখনোই দেখা যায়নি। তবে এবারের চিত্র অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। এবারের বাজি অনেক বেশি এবং দেশের জনগণ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা অতীতের মতো সরকারের নিছক মুখের কথায় ভুলবে না।

আজ আস্থা ও কর্তৃত্ব সংকটের মুখে পড়েছে সরকার। এটি বুঝতে হবে, সরকারের কর্তৃত্ব এখন ছিন্নভিন্ন। এখন তাদের কাজ জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক উন্নয়ন করা। বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে, ক্রমবর্ধমান হতাশার সঙ্গে যারা গত দুই সপ্তাহের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো দেখেছে এবং তাদের মোহভঙ্গ হয়েছে। সরকার যদি দ্রুত এবং গঠনমূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পদক্ষেপ না নিতে পারে তবে একটি পুরো প্রজন্মকে হারাবে। এটি গড়িমসি করার সময় নয়।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার যে সর্বসাধারণের কথা শুনছে, শিখছে এবং ভিন্নভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ– সে বিষয়ে কী ধরনের ইঙ্গিত দিতে পারে?

কঠিন সময়ে জটিল সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।

তাদের বড় এবং সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশের জনগণের আস্থা ও বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের সম্মান ফিরে পেতে চাইলে ক্ষমতাসীন দল এক ধাক্কায় তা করতে পারে। আর তা হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে (বিসিএল) বাতিল করা।

সোজা কথা বলা যাক।

১৯৬০ সালের ছাত্রলীগের সঙ্গে বর্তমানে বিসিএল-এর নামমাত্রই সাদৃশ্য রয়েছে। ১৯৬০ সালে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছিল।

সময় বদলায়, সেই সঙ্গে বদলায় রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোও।

১৯৫২, ১৯৬০ বা ১৯৮০’র দশকের ছাত্রলীগের অর্জনের গল্প আমি বর্তমান ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে শুনতে চাই না।

এটি সেই সময়ের গল্প ছিল আর এটি এখনকার।

আজকের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা তখনও জন্মায়নি যখন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্রলীগ একটি শক্তির নাম ছিল, যেটি ছাড়া আমরা আজ স্বাধীন হতে পারতাম না। আজকের ছাত্রলীগের অপরাধপ্রবণতা তাদের পূর্ব পুরুষদের জন্য লজ্জার ও অসম্মানের।

১৯৬০ ও ১৯৮০’র দশকের ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় দিনগুলো এবং তখনকার ও এখনকার মধ্যে যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে তা স্বীকার না করে ছাত্রলীগের অনিবার্য ভূমিকার দিকে ফিরে তাকাতে পারি না।

একটি সামরিক স্বৈরাচারের অধীনে চলা দেশ এবং একটি গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালনার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

আমরা যখন সামরিক শাসনের অধীনে থাকি, তখন সহিংস আন্দোলন ছাড়া নিপীড়নের লাঙল ছুড়ে ফেলার বিকল্প থাকে না। এরকম সময়ে আমাদের এমন ছাত্রলীগের প্রয়োজন ছিল যেটি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অগ্রভাগে দাঁড়িয়েছিল।

তবে আজ ছাত্রলীগ যে ভূমিকা পালন করেছে তা তখনকার থেকে একেবারেই আলাদা। আসলে বিড়ম্বনার বিষয় হলো, স্বৈরাচারের সময়ে যে ছাত্রলীগ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিল, আজ সেটিই তারা ক্ষুণ্ন করছে।

মূল কথা হলো, একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনুষঙ্গ হিসেবে সহিংসতার জন্য সশস্ত্র গ্যাংগুলোর কোনও স্থান নেই। স্বৈরাচারী শাসন পরিচালিত অবৈধ কর্তৃত্বকে প্রতিহত করার জন্য যখন এই ধরনের একটি সংগঠন কাজ করে তখন এর চরিত্র অনেকটাই আলাদা।

এটি আমি এখন আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি, বাংলাদেশে কেন এই কাঠামো এবং ব্যবস্থা রয়েছে।

আমি মনে করি, সহিংস ছাত্র ফ্রন্ট থাকা পারমাণবিক অস্ত্র থাকার মতো—অন্য পক্ষের যেহেতু তা আছে, তাই আপনারও থাকা দরকার এবং একতরফা নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব ঝুঁকিপূর্ণ।

আসুন এক সেকেন্ডের জন্য হলেও আমরা একটু বাস্তবিক হয়ে উঠি। আমরা গণতন্ত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশকে যদি সত্যিকার অর্থেই আমরা একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই, তবে আমাদের সহিংসতার রাজনীতির ঊর্ধ্বে যেতে হবে।

আমরা সবাই বুঝতে পারি, সাম্প্রতিক ট্র্যাজেডিটি তখনই ঘটেছিল যখন ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঝড় তোলার এবং সহিংসভাবে তা ভেঙে দেওয়ার সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছিল। সেই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণেই ছিল এবং অনেকাংশেই তা ছিল শান্তিপূর্ণ।

সমস্যাটি বোঝাতে একটি প্রবাদের কথা বলি। কথিত আছে, আপনার কাছে থাকা একমাত্র হাতিয়ারটি যখন একটি হাতুড়ি, তখন প্রতিটি সমস্যাকেই আপনার কাছে পেরেক মনে হয়।

তো, আমি তাহলে কি চাচ্ছি? আমি এমন কিছুই চাইছি যা বহু বছর আগেই হওয়া উচিত ছিল: ছাত্রলীগের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি।

আপনি বলবেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আর শিবির আছে এমন একটা দুনিয়ায় তা সম্ভব না?

আমি এমনটা মনে করি না। অন্য দেশগুলো কীভাবে পুরোপুরি ও ভালোভাবে এটি পরিচালনা করে? বাংলাদেশ কি এতটাই বর্বর ও অসভ্য দেশ যে আমরা তা করতে পারবো না?

ক্ষমতাসীন দল ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। এই সময় শাসনের জন্য একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য যথেষ্টের চেয়েও বেশি।

রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুষঙ্গ হিসেবে যতক্ষণ আমাদের কাছে এই অপরাধী দলগুলো থাকবে, ততদিন আমরা কখনোই সত্যিকারের গণতন্ত্র পাবো না। কোনও কিছুই পরিবর্তন হবে না এবং কোনও কিছুই স্বাভাবিক হবে না।

এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী দশা করছে দেখেন।

বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা শিক্ষার দুর্গকে বুঝি, যেখানে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষাদান এবং বড় করে তোলা হয়। একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার মূল্যবোধ সেখানে তারা অর্জন করে।

বাংলাদেশে কি সেটি হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশের পরিবেশ থেকে কী শিখবে আমাদের শিক্ষার্থীরা এবং সেটি কি দেশের ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক?

প্রশ্ন করা মানে উত্তর দেওয়া।

তাহলে এ অবস্থা ছেড়ে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো?

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। এ কথা বলে আমি এটি বোঝাতে চাচ্ছি না যে আমাদের প্রতিবাদ বা সংগঠিত হওয়াকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সেগুলো দারুণ ব্যাপার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য সবসময় জায়গা থাকে এবং সত্যিকার অর্থেই আমরা চাই, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিবেকবান এবং পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হোক।

তবে আমাদের সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, গুণ্ডামি এবং অপরাধপ্রবণতাকে নিষিদ্ধ করা দরকার, যা আজকের ছাত্র রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করে। এসবের জন্য কোনও স্থান থাকতে পারে না।

ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ক্যাডারদের ভূমিকার পাশাপাশি কী চলে দেখুন: পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি, হোস্টেলের বিছানা বিক্রি, হয়রানির দায়মুক্তি, যৌন নিপীড়ন এবং আরও বাজে ধরনের কাজ। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

শালীনতা ও উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এমন একটি দেশে এসব অগ্রহণযোগ্য। তবে বাংলাদেশ এর চেয়ে ভালো।

তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দিয়েই চলুন সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করা যাক। আসুন আমাদের ক্যাম্পাসগুলোকে আবারও শিক্ষার আসনে পরিণত করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা যখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলতাম তখন সেগুলো কেমন ছিল, এবং আমরা যদি দেশের জনগণ ও আমাদের পূর্ব পুরুষদের জন্য একটি যোগ্য একটি দেশ ও সমাজ গড়তে চাই তবে সেগুলো আবার কেমন হওয়া উচিত তা ভাবি।

শিক্ষাকে সবার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। দেশের সংস্কারের ক্ষেত্রে এটি শুরু করার মতোই ভালো জায়গা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী এবং আমরা বাকিরাও সরকারের কাছ থেকে বাস্তব এবং অর্থপূর্ণ কিছুই চাচ্ছি, যাতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের কথা তারা শুনছে। তারা বুঝতে পেরেছে কোন জিনিসগুলোর পরিবর্তন দরকার।

চলুন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং ছাত্রজীবনের পুরো সংস্কার দিয়ে এই যাত্রা শুরু করি। গত দুই সপ্তাহের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে সিরিয়াস তা বোঝানো হোক।

লেখক: সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন।