আর্থিক প্রতারণা: প্রতারিত হলে যা করা যেতে পারে

আর্থিক প্রতারণা একটি প্রচলিত এবং দীর্ঘদিনের সমস্যা, যা আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে দেখা দেয়। মানুষ টাকা নিয়ে প্রতারণা করে, ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেয় না, সম্পত্তি বা পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণা করে, এবং এ ধরনের আরও অনেক ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতারকরা হয় আপনার পরিচিত এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। এর কারণ হলো, আমরা সাধারণত টাকা ধার বা বিনিয়োগ করি কাছের মানুষদের ওপর ভরসা করে।

যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা প্রায়ই ভাবেন কীভাবে এই অর্থ পুনরুদ্ধার করবেন। কিন্তু আর্থিক প্রতারণার শিকার হওয়ার পরে যে মানসিক এবং অর্থনৈতিক আঘাত আসে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ নয়। ফোর্বাসের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা আর্থিক প্রতারণার শিকার হন, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ এক ধরনের হতাশা এবং মানসিক চাপে ভোগেন, যা তাদের ভবিষ্যতে বিনিয়োগ এবং আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। (সূত্র: ফোর্বাস, মে ২০১৮)।

আপনার যদি কারও কাছে টাকা বকেয়া থাকে, তাহলে প্রথম কাজ হলো সেই টাকা কীভাবে ফেরত পাওয়া যায়, তার একটি পরিকল্পনা তৈরি করা। তবে প্রথমেই বুঝতে হবে যে শুধু লোভের বশে কারও কথায় বিনিয়োগ করা বা ঋণ দেওয়া ভুল হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন পরিচিত ব্যক্তি হয়তো আপনাকে এমন একটি ব্যবসায়িক প্রস্তাব দেবেন যেখানে অধিক লাভের প্রতিশ্রুতি থাকবে। আপনি সেই প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে টাকা দেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন যে এটি ছিল প্রতারণার একটি ফাঁদ।

প্রথমে, আপনি যাকে টাকা দিয়েছেন, সেই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং চেষ্টা করুন সমস্যা সমাধান করার। আপনার কাছে যদি কোনও প্রমাণ থাকে, যেমন– লিখিত চুক্তি, রিসিট বা অন্য কোনও দলিল, তাহলে আপনি আইনগত উপায়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন।

বিশ্বব্যাপী বহু দেশেই অর্থনৈতিক প্রতারণার বিরুদ্ধে আইন রয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যারা প্রতারণার শিকার হন এবং আইনি ব্যবস্থা নেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ অর্থ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। তাই, আপনার কাছে যদি টাকা দেওয়ার কোনও বৈধ প্রমাণ থাকে, তাহলে স্থানীয় আইনজীবীর সাহায্য নিয়ে প্রতারককে আইনি পথে মোকাবিলা করতে পারেন।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, আমরা প্রায়ই সম্পর্ক রক্ষার কথা ভেবে অর্থ ফেরত চাইতে লজ্জাবোধ করি। অনেকেই ভাবেন, যদি টাকা ফেরত চাই তাহলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেসব সম্পর্ক টাকার কারণে নষ্ট হয়, সেগুলো আগে থেকেই দুর্বল। আপনি যদি কারও সাথে টাকার লেনদেন করেন এবং সেই টাকা ফেরত না আসে, তবে সেই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

যেমন, হার্ডভার্ড বিজনেস রিভিউয়ে ২০১৮ একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা ঘনিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নেন এবং সময়মতো ফেরত দেন না, তাদের সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

অনেকেই অধিক মুনাফার আশায় নিজের সঞ্চয় বা অর্থ অন্য কারও হাতে তুলে দেন। এ ধরনের বিনিয়োগ বা ঋণ দেওয়া হলো একটি বড় ভুল, বিশেষ করে যদি আপনি সেই টাকার প্রয়োজন বুঝতে না পারেন। আপনার উচিত হবে কখনও এমন কোনও টাকা বিনিয়োগ না করা যা আপনার মূল আর্থিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে। অর্থাৎ আপনি যে টাকার জন্য নিজে বিপদে পড়তে পারেন, তা কখনোই কাউকে ধার বা বিনিয়োগ করবেন না।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের (২০২০) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তাদের জরুরি সঞ্চয় ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যান, তারা প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।  প্রথমেই বুঝতে হবে, অর্থনৈতিক প্রতারণা থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতা জরুরি।


আপনি যদি অর্থ বিনিয়োগ বা ঋণ দেওয়ার আগে সবকিছু যাচাই না করেন, তাহলে প্রতারণার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এখানে কয়েকটি সতর্কতামূলক পরামর্শ—

প্রমাণ রাখুন: কোনও অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখিত প্রমাণ রাখুন, যেন আপনি ভবিষ্যতে আইনগত সাহায্য নিতে পারেন।

অধিক লাভের প্রলোভনে পড়বেন না: কারও কথায় অধিক লাভের প্রতিশ্রুতি শুনে বিনিয়োগ করবেন না। বিনিয়োগের আগে বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা করুন এবং বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।

পরিবারের সদস্যদের সাথেও সাবধান থাকুন: পারিবারিক বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেও আর্থিক প্রতারণা হতে পারে। তাই পরিবারের সাথেও আর্থিক লেনদেনে সাবধান থাকুন।

যারা আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়েছেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপদেশ হলো, ধৈর্য ধরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া। প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে আবার একই ভুল করবেন না। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা প্রতারণা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও সচেতন হন, তাদের মধ্যে আর্থিক সাফল্যের হার প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়।

তাই, প্রতারণার শিকার হওয়ার পরে আপনার করণীয় হলো, কীভাবে সেই টাকা পুনরুদ্ধার করা যায়, তার পরিকল্পনা করা এবং ভবিষ্যতে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আরও সচেতন থাকা। মনে রাখবেন, আপনার অর্থের মালিক আপনি এবং সেই অর্থ সঠিকভাবে পরিচালনা করাও আপনার দায়িত্ব।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট; সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।