সাম্প্রতিক শিশু হত্যা প্রসঙ্গে

মাহমুদুল সুমনএফএম রেডিও শুনছিলাম। হঠাৎ একজন পুরুষ কলার প্রশ্ন করলেন অনুষ্ঠানটির আরজকে (রেডিও জকি): ‘আপু, এখনতো আমদের দেশের মায়েরা নিজেদের সন্তানদেরই মেরে ফেলছেন’। কলারের এই প্রশ্নে এতক্ষণ অনর্গল কথা বলতে থাকা আারজে, যিনি কিনা একজন নারী, একদম চুপ হয়ে গেলেন। এরপর (সম্ভবত) একটু সামলে নিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে কথা বলতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। সুতরাং এটা নিয়ে এখন আর কথা বলা যাবে না’ (রেডিও থেকে শোনা অনুষ্ঠান, স্মৃতি থেকে লেখা) । কথা বলার এই অংশে আমাদের আরজে তার স্বভাবসুলভ আহ্‌লাদিপনা ও চপলতাকে একদম বিসর্জন দিলেন। বোঝা গেল, এই প্রশ্নের উত্তরে চট জলদি কোনও উত্তর তার জানা নেই। আরও বোঝা গেল, আরজের কাছেও বিষয়টি সিরিয়াস, সচরাচর ইথারে ভেসে আসা ভালোবাসার প্রস্তাবের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ‘ও মাই গড’ বলে বিষয়টি হাল্কা করা যাচ্ছে না।  
সম্প্রতি বাংলাদেশে শিশু হত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে বেশ কিছু খবর এসেছে। সিলেটের শিশু রাজন থেকে শুরু করে খুলনার শিশু রাকীবসহ আরও কিছু হত্যাকাণ্ড আমাদের হতভম্ব করেছে। আর ঘটনাগুলোর কিছু কিছু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের নজরে এসেছে অন্য সময়ের তুলনায় আরও বেশি।  এর ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়াটিও আমরা যারা বাংলদেশের নেটিজেন (নেট ভিত্তিক সিটিজেন), তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখেছি ও প্রতিক্রিয়া করেছি। সামাজিক যোগাযোগে প্রবল সমালোচনার মুখে এবং মিডিয়ার ভূমিকার কারণে অনেকে মনে করেন অন্তত রাজন হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে।    
কিন্তু গত কয়েকদিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া পিঠেপিঠি শিশু হত্যাকাণ্ড (তার একটি ঢাকার বনশ্রী এলাকায় যেখানে ভাইবোনকে খুন করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে ও অন্যটি ঢাকার বাইরে একটি ঘটনা যেখানে পত্রিকা মারফত জানা গেছে যে, একটি নবজাতক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে) সম্ভবত জনমানসে আবার শিশু হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ওপরের রেডিও আলাপ তারই ইঙ্গিতবহ। পত্রিকা মারফত যে খবর, তাতে দুই ক্ষেত্রেই অনুমান করা হচ্ছে যে, এই হত্যাকাণ্ডে মা জড়িত। ঢাকার ঘটনাটি সামান্য ঘোলাটে লাগলেও ঢাকার বাইরের একটি ঘটনার বিবরণ থেকে মনে হয় শিশু পালনে অতিষ্ট হয়েই মা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।
এই ঘটনায় আমিও অন্য আরও অনেকের মতো মর্মাহত হলেও একটি বিষয় আমার মাথায় আলতো করে হলেও খেলে গেছে। সেই ভাবনার একটি সমবায় এই লেখায় আমার উদ্দেশ্য। যেকোনও পিতৃতান্ত্রিক সমাজেই মায়ের ভালোবাসা, আদর ও ত্যাগকে যেভাবে আদর্শায়িত করা হয়, বা স্বাভাবিক করে তোলা হয়, বাংলাদেশের সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়। নানা বয়ান থেকে (পত্রপত্রিকাসহ সব কিছুতেই, বিস্কুট থেকে শুরু করে হরলিকসের বিজ্ঞাপনে) আমাদের মনে না করার কোনও কারণ থাকে না যে, মাকে হতে হবে ত্যাগী, মাকেই সন্তানের দেখভাল করতে হবে। সে পরিস্থিতি যাই হোক (তিনি কর্মজীবী নারী হোন বা না হোন); তিনি বাড়িতে সবাইকে খাইয়ে তারপর নিজে খাবেন। ছোটবেলায় নানির কাছে বড় হওয়ায় নানিকে নিয়ে এরকম সেক্রিফিসিয়াল গল্প আমি অনেক শুনেছি এবং হয়তো খুশিও হয়েছি। তার সম্মান আমার কাছে বেড়েছে!
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তাই এই স্বাভাবিকতবাদ থেকে অলাদা, একেবারে ভিন্ন এক গল্প। একটা ধাক্কা হয়তো অনেকের জন্য। আমি ঘটনার সত্য-মিথ্যা এখানে বিচার করতে যাচ্ছি না। একধরনের মিডিয়া ট্রায়াল এখানে হয়ে গেছে এবং সত্য যাই হোক, জনমানসে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, মায়েরাও তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন।

 

এ প্রসঙ্গে একটি বইয়ের কথা আমার মনে পড়ছে। বহু বছর আগে ব্রাজিলের একটি ছোট শহরের একটি বস্তির ওপর রচিত এথনোগ্রাফিতে নৃবিজ্ঞানী ন্যানসি শেফার-হিউজ গবেষণা করে দাবি করেছিলেন যে, ওই বস্তিবাসীদের জীবনে একটি নিয়মিত ঘটনা ছিল, ছোট-ছোট শিশুকে নানা রকম অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করা। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ওই সমাজটিতে নৈতিকতাবোধের একধরনের সাসপেনশন দেখা দিয়েছিল। খুব সামান্য কারণেই বিভিন্ন গৃহস্থালীতে একাধিক শিশুর একটা দুটো মারা যেত এবং মায়েদের অবহেলা তার পেছনে একটা কারণ ছিল। এ কারণে তিনি সম্ভবত বইটির নাম দিয়েছিলেন ডেথ উউদাইট উইপিং। নৃবিজ্ঞানী শেফার-হিউজ নিজে একজন মা ছিলেন এবং গবেষণা করতে এসে দেখা এই ঘটনাগুলো তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। মেনে নিতে পারছিলেন না তার গবেষিত জনগোষ্ঠীর এই বয়ান যে কিছু কিছু বাচ্চা জন্মই হয় মরবার জন্য, এগুলো ছোট-ছোট পরীর মতো যারা দ্রুতই চলে যায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। তিনি স্বীকার করেছিলেন, গবেষক হিসেবে তার আমেরিকান সেনিসবিলিটিতে এ রকম ঘটনা ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ও প্রতিরোধযোগ্য। 
কিন্তু সার্বিক প্রস্তাবনায় তিনি যখন গবেষণাটি শেষ করলেন তখন তিনি এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন যে, মায়ের ভালোবাসার মতো বিষয়গুলোকেও (যেগুলোকে স্বাভাবিক ও সর্বজনীন হিসাবে দেখার প্রবণতা কোনও কোনও বিদ্যায়তনিক পরিসরেও আছে) দেখতে হবে ঐতিহাসিকতার মধ্য দিয়ে ও নির্দিষ্টভাবে। অর্থাৎ যে সমাজে এই ঘটনাগুলো ঘটছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রথমে ধাক্কা লাগলেও ব্রাজিলের একটি অঞ্চলের এই অবহেলার চর্চাকে (যা গৃহস্থালীর ব্যক্তিগত পরিসরে সংঘটিত হলেও) তিনি সংযুক্ত করেছিলেন ওই সমাজের নারী পুরুষের অসম সম্পর্কের ভেতরে, বৃহত্তর আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে, গুম-খুন ও হত্যাকাণ্ডের বাস্তবতার সঙ্গে এবং দৈনন্দিন সহিংসতা জনিত অনিশ্চয়তার সঙ্গে (১৯৬০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া এই গবেষণা  শেষ হয়েছিল ১৯৮০ এর দশকে; এই সময়ে ব্রাজিলে লম্বা সময় সামরিক শাসন চলেছে, নির্বিচারে বিরোধী শক্তিকে হত্যা করা হয়েছে)। সেখানকার চার্চে নারীর সন্তান জন্ম ও প্রতিপালন প্রশ্নে অনিশ্চয়তা থেকে শুরু করে সরকারি বাহিনীর বিরোধী শক্তি দমন, কোনও কিছুকেই বাদ দিতে নারাজ ছিলেন এই নৃবিজ্ঞানী।  তিনি মনে করেছিলেন, প্রাইভেট  পরিসরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলোকে বৃহত্তর পাবলিক পরিসর থেকে কোনওভাবেই আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।

শিশু হত্যার ঘটনাগুলেকে তাই আমাদের আরও মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার। যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে আমরা বসবাস করছি, তার নিরিখে বিচার করা দরকার, প্রেক্ষিতকরণ করাটা জরুরি। সেগুলো আমরা দেখছি না। দেখছি একধরনের ঢালাও মন্তব্য, পত্রপত্রিকায় ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সেন্সেশিয়ালিজম বর্জন করে কাজ করতে পারাটা জরুরি। এই বিষয়ে প্রয়োজন আরও গবেষণার, আরও নানবিধ বিষয়ভিত্তিক জায়গা থেকে অনুসন্ধান। সেই গবেষণা  যেহেতু এখনই হচ্ছে না, তাই আপাতত মায়েদের নিয়ে ঢালাও মন্তব্য না করে (যা করা খুব সহজ আমাদের মতো পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে) ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বুঝতে নিজেদের জিজ্ঞাসাগুলোকে ঠিক করি।

লেখক:  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।