ব্যানারে সীমাবদ্ধ শব্দ

একটি সময় ছিল যখন রিকসা-চালককে ভাড়া জিজ্ঞেস করলে তারা বলত, ‘ন্যায্য ভাড়া দিয়েন’। ওই সম্মানসূচক কথাগুলোর তাৎপর্য ছিল বিশাল। আরোহীর বিচার-বিবেকের ওপর আস্থার ভিত এতই মজবুত যে আশা অনুযায়ী ভাড়া না পেলেও তেমন উচ্চ- বাচ্য হতো না। সামাজিক সম্মুখ যাত্রায় কেন জানি সেই সম্মান আর আস্থা কোথায় মুখ থুবরে পড়ে গেছে। দেশপ্রেম, আস্থা, ন্যায্যতা কথোপকথনের মুক্ত ডানা থেকে সরে এসে ব্যানারের সীমাবদ্ধতায় আটকে গেছে। তাই বিশ্বস্ততার প্রতীক ব্যাংক ট্যাগ লাইনে আস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য হয় এই আশায়, যে নিরাশার সাগরে বিশ্বাসের ছিটে-ফোটা রেশ যদি ধরে রাখা যায়।
ন্যায্য এমনই শব্দ যার পরপরই চলে আসে তার বিপরীত অর্থ অন্যায্য। সেটা যে অস্বাভাবিক তাও বলা যাবে না। বাংলার কিছু শব্দ ওরকমই । অন্যায্য কিছু হচ্ছে বলেই তো ন্যায্যতা নিয়ে প্রসঙ্গ ওঠে। বহুকাল ধরে ন্যায্য মূল্য শব্দগুলো সবার মনেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কম বা ন্যায্য দামে পণ্য বা সেবা ক্রয় মনের কাছের প্রিয় বিষয়। কষ্টার্জিত আয়ের সাশ্রই ব্যয় সবারই লক্ষ্য, বিশেষ করে দুর্মূল্যর বাজারে।
ব্যবসার পুরোনো সেই হিসেব-লাভ করতে হবে, কিন্তু কতটা লাভ? অত্যাবশ্যকীয় এবং সৌখিন পণ্যের ক্ষেত্রে সাধারণত: ব্যবসায়ীদের জয়জয়কার। যে পণ্য না কিনলেই নয়, তা বাড়তি দামে কিনে বা কম ব্যবহার ছাড়া গতি নেই। শৌখিনতা, বিশেষ করে যারা সেই বিলাসিতা করার সামর্থ রাখেন, এমনই ইচ্ছে যার সীমানা কেবল ব্যক্তির ইচ্ছে শক্তি। নিত্য প্রয়োজনীয়তা পণ্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এবং দুর্লভ চাহিদা-চালানের অসম সমীকরণ সমাধানে রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। উদ্দেশ্য সাধারণ জনতা হলেও মূলত: লাভবান হন মধ্যবিত্ত সমাজ।

 

স্বভাবসুলভ দুর্নীতির কারণে, বিত্তশালীরা তো বটেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কাছে চলে যায় নিয়ন্ত্রণ। প্রাথমিক পর্যায়ে চাহিদা কমাতে গুণগতমান এবং পরবর্তিতে চালানোর অনিয়মের মাধ্যমে ব্যবস্থাটির অকাল মৃত্যু ডেকে আনা হয়। পাশাপাশি গড়ে ওঠা মাথা পিছু আয় এবং দারিদ্রের উন্নতির কারণে সামাজিক বিপ্লব জন্ম নেয় নি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের শ্রেণির উচ্চলাভ ভিত্তিক প্রবণতার কারণেই ন্যায্য আর ন্যায্য রইল না। চালু হলো ন্যায্য মূল্যে নির্যাতন প্রয়োজনীয়তা পণ্য বিক্রির সরকারি উদ্যোগ। নির্ধারিত মূল্যে খাদ্য শস্য কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করে, কেবল বিক্রয় ব্যবস্থার খরচ পুষিয়ে, এই কার্যক্রমের মূল্য নির্ধারণ হয়। সমস্যা দাড়ালো দুটি কারণে।

পণ্যের গুণগত মান এমনই, যে দরিদ্ররাও তা কিনতে রাজি নন। অন্য দিকে গুদামের অভাবে নতুন ক্রয়কৃত পণ্য গুদামজাত করার সুযোগ থাকছে না। অতএব- ভর্তুকি। ক্রয় মূল্যের নিচে নতুন মূল্যে বিক্রির চেষ্টা চলছে। কোষাগারে ক্ষতি হবে বৈকি, কিন্তু সামাজিক এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। প্রশ্ন তিনি আসে ‘ন্যায্য মূল্য’ কোনটি? নাকি প্রথমে নির্ধারিত মূল্য অন্যায্য ? আর এটি যদি ন্যায্য হয়ে থাকে, তবে বাজারে যে একই পণ্য বিকোয়, তার মূল্য নিশ্চয়ই অন্যায্য? সে ক্ষেত্রে সরকারের কি দায়িত্ব নয় পদক্ষেপ নেওয়া? কেন যেন ভোক্তা অধিকার আর ন্যায্যতা নিয়ে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। হয়তো সেই কারণে আজকাল রিকসা-চালক আরোহীর বিচার-বিবেচনায় ভাড়ার দায়িত্ব দিতে রাজি নন।

লেখক: কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ