৪০ দিন পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ!

প্রভাষ আমিনবাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। তাদের আবেগের কোনও মাথা-মুণ্ডু নেই। কখন কাকে মাথায় তুলবে, কখন কাকে আছাড় দেবে, ঠিক নেই। মোহাম্মদ আশরাফুলের ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার খবরে চারিদিকে ছিঃ-ছিক্কার পড়ে গেল। যেই তিনি চোখের জলে জাতির কাছে ক্ষমা চাইলেন, বেশির ভাগ মানুষই তাকে ক্ষমা করে দিলেন। বলতে লাগলেন, ‘বাচ্চা মানুষ একটা ভুল করেছে। সেই ভুল তো আবার স্বীকারও করেছে। কজনই বা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়।’ তাতে মনে হতে পারে, ভুল স্বীকার করলেই বুঝি বাঙালি ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু এ ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে মাহফুজ আনামের ক্ষেত্রে। ওয়ান-ইলাভেনের সময় অনেকেই ভুল, অপরাধ বা বাড়াবাড়ি করেছেন। কেউই তা স্বীকার করেননি। কিন্তু ভুল স্বীকার করেই যেন বিপাকে পড়েছেন মাহফুজ আনাম। এখন তিনি গোটা দেশ ঘুরে-ঘুরে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের রিজার্ভ লুটের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ড. আতিউর রহমান যখন পূর্ব নির্ধারিত কনফারেন্সে নয়াদিল্লি চলে গেলেন, তখন তার অনুপস্থিতিতেই তার মুণ্ডুপাতের মচ্ছব হলো, ‘তিনি কেন জানালেন না। তিনি কেন এত বড় ঘটনা ফেলে দিল্লি গেলেন। তার কাছে দেশের রিজার্ভের চেয়ে সেমিনার বড় হলো!’ ইত্যাদি-ইত্যাদি সমালোচনার ঝড়। পারলে নয়াদিল্লিতেই তার বরখাস্তের চিঠি পাঠিয়ে দেন কেউ-কেউ। এমনকি দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউ-কেউ ড. আতিউর রহমানের অতীত নিয়েও টানাটানি করলেন, কথা তুললেন জাত-পাত নিয়ে। সেই ড. আতিউর রহমানই যখন চোখের জলে পদত্যাগের কথা বললেন, উল্টে গেল গণেশ। গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে এখন সহানুভূতির বন্যা, ‘পদত্যাগ করার মতো এমন সৎসাহস কজনের আছে?’ দুদিন আগে যারা ড. আতিউর রহমানকে প্রায় চোর বলে ফেলছিলেন, তারাই এখন তাকে মহাপুরুষ বানাতে চাইছেন।

তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। শেষ হলে জানা যাবে, রিজার্ভ লোপাটের ঘটনায় কারা জড়িত। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এর সঙ্গে ড. আতিউর রহমানের দূরতম কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। তার সততা নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে, দূরদর্শিতা নিয়ে আমার মধ্যে কোনও সংশয় নেই। ড. আতিউর রহমান যুগ-যুগ ধরে অসহায়, দরিদ্র মানুষের সামনে উদাহরণ হয়ে বেঁচে থাকবেন। গ্রামের ছেলেদের আমি সবসময় ড. আতিউরের উদাহরণ দেই। রাখালবালক থেকে যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছেন। তিনি গভর্নর হওয়ার পর অন্যদের মতো প্রচলিত ধারায় চিন্তা না করে আউট অব দ্য বক্স ভেবেছেন। তিনি ব্যাংকিং ব্যাবস্থাকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। ব্যাংকের দরজা দিয়ে যারা ঢোকার সাহস পেতেন না, এমন অনেক প্রান্তজন এখন ব্যাংকের সম্মানিত গ্রাহক। মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে তিনি বদলে দিয়েছেন ব্যাংকিংয়ের প্রচলিত ধারণা। একদম মাটি থেকে উঠে আসা একজন যখন রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে সুললিত কণ্ঠে প্রমিত উচ্চারণে মনোমুগ্ধকর কথা বলেন, আমরা অভিভূত হয়ে যাই। এমন একজন গভর্নর আমাদের আছেন ভেবে আমরা গর্বিত হই।

কিন্তু তারপরও তার পদত্যাগে আমি কোনও মহত্ব খুঁজে পাইনি। তিনি দাবি করেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আসলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ঘটনার ৪০ দিন পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। নয়াদিল্লি থেকে ফিরে তিনি চাকরি বাঁচাতে অর্থমন্ত্রীর বাসায় ছুটে গেছেন। অর্থমন্ত্রী যখন মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, আপনি গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো চলবে, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছেন, পাননি। ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মনোভাব তিনি বুঝে গেছেন। নয়াদিল্লি যাওয়ার আগে তিনি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কিছু বলেননি। বরং এ বিষয়ে প্রশ্ন করে সাংবাদিকরা তার ঝাড়ি খেয়েছেন। কিন্তু দিল্লি গিয়ে তিনি ঠিকই মুখ খুলেছেন। নিজে বাঁচতে টেনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। আমার বিবেচনায় গোটা ঘটনায় তার সবচেয়ে বড় অপরাধ প্রধানমন্ত্রীকে টেনে আনা, মারাত্মকভাবে চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন করা। প্রধানমন্ত্রী বরাবর লেখা পদত্যাগপত্রে ড. আতিউর রহমান লিখেছেন, ‘বিষয়টি এত জটিল ও অজানা যে, অনেকটা ভূমিকম্পের মতো মনে হচ্ছিল। কোন দিকে এই আক্রমণের ঢেউ আসবে, কখন আসবে, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এই সাইবার আক্রমণটি জঙ্গি আক্রমণের মতোই মনে হচ্ছিল।’ পদত্যাগের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ‘পাজলড’ হয়ে গিয়েছিলেন। এখানেই তার ব্যর্থতা আর অদক্ষতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হয়, পাজলড হলে চলে না। বুঝে উঠতে পারা না পারাতেই দক্ষতা আর অদক্ষতার পার্থক্য। ড. আতিউর রহমান প্রমাণ করেছেন; তিনি সৎ কিন্তু দক্ষ নন।

 

ভালো নেতা কখনও তার অধস্তনদের বিপদের মুখে ঠেলে দেন না। নিজের বুক পেতে বিপদের মুখে দাঁড়ান। ড. আতিউর রহমানও হয়তো তার অধস্তন কাউকে বাঁচাতে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর এই চেষ্টা করতে গিয়েই তিনি ভুল করেছেন। এত বড় ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া যায় না। ঊর্ধ্বতনদের জানানোর বিলম্বের কথাটি তিনি স্বীকার করেছেন। দেরির কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘তদন্তাধীন বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে খানিকটা সময় লেগেছে।’ এই ‘খানিকটা সময়’ একমাসেরও বেশি। দেশের রিজার্ভের ৮০০ কোটি লোপাট সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে একমাসের বেশি সময় লাগাটা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

 আগেই বলেছি, এ ঘটনায় ড. আতিউরের মূল অপরাধ প্রধানমন্ত্রীকে জড়ানো। চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আগে জানিয়েছেন, তবে সেটাও প্রায় একমাস পর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক ডাইনামিক। প্রায় সব দিকেই তার নজর। এটা সবাই বুঝে গেছে। তাই কোনও ঝামেলা হলেই সবাই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি সরকার চালান, দল সামলান, প্রধান বিরোধী দলের অভ্যন্তরীন কোন্দল মেটান, ছেলের জন্মদিনে পোলাও রান্না করেন, নাতী-নাতনিদের আবদার মেটান। সবকিছুই করেন তিনি নিপুণ দক্ষতায়। সবদিকে প্রধানমন্ত্রীর নজর আছে বলেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার কারণেই বিশ্বব্যাংককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সবকিছুর এই এককেন্দ্রিকতা সুশাসনের লক্ষণ নয়। সবাই যার যার কাজ করলে প্রধানমন্ত্রীর চাপ কিছুটা কমে। তিনি আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সময় দিতে পারেন। গভর্নরের উচিত ছিল, ঘটনা জানার সঙ্গে-সঙ্গেই অর্থমন্ত্রীকে তা জানানো। তিনি তো অর্থমন্ত্রীকে জানাইনি, এমনকি পদত্যাগটাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরাবর। অর্থমন্ত্রী গভর্নরের এই ভূমিকাকে বর্ণনা করেছেন ‘অডাসিটি’ হিসেবে। গভর্নরের নয়াদিল্লি যাওয়ার আগে আর পরে পরিস্থিতির তো কোনও বদল হয়নি। তাহলে তিনি আগে না করে, পরে পদত্যাগ করলেন কেন? কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন পদত্যাগ না করলে, তাকে সরিয়ে দেওয়া হতো। বাংলাদেশে সবাই মেঘ বুঝে ছাতা ধরতে উস্তাদ। গভর্নরের বিদায় অবশ্যম্ভাবী বুঝে সবাই তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ড. আতিউরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’ বললেন, অমনি সবাই সুর মেলালেন, ঠিক ঠিক, দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করার সৎসাহস কজনের আছে।

এই ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতার বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর যখন অর্থমন্ত্রীকে পাত্তাই দেন না, তখন অর্থমন্ত্রীর পদে থাকাটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। আর রিজার্ভ লুটের ঘটনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে গভর্নর পদত্যাগ করলে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারির দায় অর্থমন্ত্রী নেবেন না কেন?

পদত্যাগের পর নিজ বাসায় আবেগঘন সংবাদ সম্মেলনে ড. আতিউর রহমান তার ৭ বছরের সাফল্যের ফিরিস্তি দিয়েছেন। তার সবই সত্যি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সবচেয়ে স্থিতিশীল। রিজার্ভ ৬ বিলিয়ন থেকে ২৮ বিলিয়নে তুলে এনেছেন। টাকার মান বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। এমন সফল একজন গভর্নরের এমন বিদায় কাম্য নয়। তবে তিনি বিদেশ সফর আর পুরস্কারের ব্যাপারে একটু বেশিই মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু তার সব সাফল্য, সব অর্জন ম্লান হয়ে গেল তার ট্র্যাজিক বিদায়ে।

তবে আমরা যেন ড. আতিউর রহমানের বিদায় নিয়ে মগ্ন থেকে আসল বিষয় থেকে মনোযোগ না সরাই। আমাদের মূল মনোযোগ হওয়া উচিত কারা, কিভাবে রিজার্ভ লোপাট করলেন, তাদের চিহ্নিত করা, বিচার করা। রিজার্ভ অর্জন যেমন কৃতিত্ব, তা নিরাপদ রাখাও আমাদের দায়িত্ব।

লেখক:  অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 ইমেল: probhash2000@gmail.com