গর্ত খোঁড়ার উন্নয়ন

উন্নয়নের সহজ সংজ্ঞা হলো, গতকালের চেয়ে ভালো থাকা। অর্থাৎ গতকাল যেটি ছিল বাঁশের সাঁকো, আজ সেটি কালভার্ট অথবা সেতু। গতকাল যেটি টিনের ঘর, আজ সেটি দালান।
কিন্তু এই উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য লাগে সুশাসন। অর্থাৎ সেতু কালভার্ট নির্মাণে যদি আপনি অর্ধেকের বেশি চুরি করেন, যদি প্রয়োজনীয় ইট-রড-বালু-সিমেন্ট না দেন, তাহলে সেই উন্নয়নের চাপায় নাগরিকের মৃত্যু হবেই।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যদি সঠিক নজরদারি আর জবাবদিহিতা না থাকে, তাহলে ফ্লাইওভারের লোহার টুকরা পড়ে পথচারীর মৃত্যু নিশ্চিত; তখন গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরণে একটি পরিবার পুড়ে ছারখার হবেই; সেই উন্নয়নের গর্তে পড়ে নাগরিকের জীবন বিপন্ন হবেই। বস্তুত বছরের পর বছর এসব উন্নয়নই হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। শুধু ঢাকাতেই নয়-সারাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের চিত্র মোটামুটি একইরকম।
ঢাকা শহরের যে এলাকাতেই আপনার বসবাস হোক না কেন, বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন- ওয়াসা, তিতাস, সিটি করপোরেশন বা টিঅ্যান্ডটির বছরব্যাপী নানাবিধ ‘উন্নয়ন কমর্কাণ্ডে’ আপনি অবশ্যই অতিষ্ঠ। আপনার বাসা যদি হয় একটু গলির ভেতরে, তাহলে আপনার দুর্ভোগ আরও বেশি।
বাসা থেকে বের হয়েই দেখবেন রাস্তাজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি। তার ওপর একটু বৃষ্টি হলে পুরো পথ কাদায় মাখামাখি। আপনার ইস্ত্রিকরা শুভ্র জামা-কাপড় আর পলিশড জুতোর ওপর দিয়ে যাবে উন্নয়নের রেলগাড়ি। আপনি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবেন। বির বির করবেন। বিরক্তি প্রকাশ করবেন। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারবেন না। বললেও কেউ আপনার কথা কানে নেবে না। আপনি আপনার ওয়ার্ড কমিশনারের কাছেও যেতে পারবেন না। কারণ এসব উন্নয়নের দেখভাল তারা করেন না। তাদের আরও অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ আছে। আবার এসব কাজের দেখভাল করার এখতিয়ারও অনেক সময় তাদের থাকে না। অতএব চোখের সামনেই আপনি দেখতে থাকবেন বছরজুড়ে এসব উন্নয়নের নৈরাজ্য। রাজধানীর ভাগ্যবান নাগরিক হিসেবে আপনাকে উন্নয়নের এই যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হবেই।
২.

নতুন ও উন্নত পাইপলাইন বসিয়ে নাগরিককে আরও বেশি পরিমাণে এবং আরও বিশুদ্ধ পানি দেওয়ার দায়িত্ব ওয়াসার। তারা সেই মহান ব্রত পালনের জন্য দফায় দফায় রাস্তা খুঁড়ে যাবে এবং তারপর তিতাসেরও মনে হবে, নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে গ্যাসের পাইপলাইন সংস্কার করা দরকার। সুতরাং তারাও রাস্তা খুঁড়বে। এরপর টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মনে হবে, যোগাযোগই শক্তি। অতএব অপটিক্যাল ফাইবার লাইন বসাতে হবে। কিন্তু রাস্তা খুঁড়ে চলে যাবার পরে কারা ওই রাস্তাটি সংস্কার করবে বা যানবাহন ও নাগরিকের চলাচলের উপযোগী করে তুলবে, সেই লোক আপনি খুঁজে পাবেন না। ফলে উন্নয়নের এই ঘানি আপনাকে টানতেই হবে।

 

 

রাজধানীর উত্তরায় যে পরিবারটি গ্যাসের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো, তারও দায়ভার এই উন্নয়নের। ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল- গ্যাসের পাইপলাইন ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে তাদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হলো- আসলেই লাইনে ত্রুটি ছিল।

সবশেষ বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে একটি ছয়তলা ভবনের চারতলায় গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরণে আগুন লাগে। এতে ভবনের কয়েকটি তলার দেয়াল ভেঙে যায়। ওই ভবনটির সামনের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। আর এই উন্নয়নযজ্ঞের কারণে সেখানে গ্যাসের লাইন ফুটো হয়ে গ্যাস বের হয়। এই ভবনের বাসিন্দারাও বিষয়টি জানিয়েছিলেন তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তাদের শ্রমিক সংকট। ফলে তারা পরামর্শ দিলেন, শ্রমিক জোগাড় করে দিন, কাজ করে দেব। একটি রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার কাছ থেকে নাগরিকরা এর চেয়ে ভালো আচরণ আর কি আশা করবেন!

৩.

কর্তৃপক্ষকে কখনো এসব প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, নানাবিধ নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিকল্প নেই। কিন্তু দেখা যায় অর্থবছরের শুরু কিংবা মাঝামাঝি এসব খোঁড়াখুঁড়ির প্রবণতা বেড়ে যায়। দুষ্ট লোকেরা বলেন, প্রতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে বরাদ্দের টাকায় উন্নয়ন দেখাতে মার্চ, এপ্রিল, মে- এই তিন মাসে উন্নয়ন কাজ শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাগুলো। অথচ আগের বছরের মে মাসেই এদের নামে বিশাল আকারের বাজেট বরাদ্দ করা হয়। আবার মার্চ, এপ্রিল ও মে- এই তিন মাস মূলত বর্ষা মৌসুম। বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করা হলে সেই কাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় মাসেও শেষ হয় না।

আবার খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনও সমন্বয়ও থাকে না। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী কোনও পরিকল্পনা বা বিধিনিষেধ না থাকায় একই রাস্তার ওপর দিয়ে যায় উন্নয়নের এই স্টিম রোলার। অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে উল্লিখিত কাজ শেষ না করেই কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে দ্বিগুণ বিল তুলে নিয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যদি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বদলে নাগরিকের দুর্ভোগ এবং জীবন বিপন্নের কারণ হয়, তাহলে সেই উন্নয়ন দিয়ে তারা কী করবে? উন্নয়নের মানে যদি হয় বড় বড় প্রকল্প, বড় বড় বাজেট আর বড় বড় চুরি- তাহলে সাধারণ মানুষ সেই উন্নয়নের বিরুদ্ধেই এক সময় হয়তো দাঁড়িয়ে বলবে- ভিক্ষা চাই না, কুত্তা থামান।

রাজধানী ঢাকার বয়স বলা হয় কমপক্ষে চার’শ বছর। কোনও কোনও গবেষণা বলছে আরও বেশি। কিন্তু এত বছর পরও এই শহর এখনও নির্মাণাধীন। ফলে প্রশ্ন ওঠে, এই শহরটি আরও কত বছর এভাবে নির্মাণাধীন থাকবে। আরও কত বছর এই শহরে ভবন উঠতেই থাকবে। আরও কত বছর রাস্তা-অলি-গলি খুঁড়ে একবার পানির পাইপ, একবার গ্যাসের লাইন আর একবার স্যুয়ারেজ লাইন সংস্কার/উন্নয়ন করা হবে? এই শহর কি আদৌ পূর্ণতা পাবে কোনওদিন? নাকি একদিন হঠাৎ করে কোনও এক দুর্বিপাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হবে? হয়তো সেই ট্র্যাজেডি দেখার জন্যই অপেক্ষা করছে এই মহানগরীর দুই কোটি মানুষ।

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর