একাত্তরের স্মৃতি

গত ১৭ মার্চে পেঙ্গুইন ইণ্ডিয়ার আয়োজনে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বিষয় ছিল পাকিস্তান কার চোখে কী রকম। প্রাক্তন মন্ত্রী শশী থারুর ছিলেন, আরও বাঘা বাঘা বক্তা ছিলেন। আমিও ছিলাম বক্তাদের একজন, তবে স্বল্পভাষী এবং অবশ্যই মৃদুভাষী। পাকিস্তানিদের প্রথম কখন দেখি, এরকম প্রশ্নের উত্তরে বলেছি, একাত্তরে যুদ্ধের সময়, যখন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের বাড়ি লুঠ করতে এসেছিল, বাবাকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছিল, বেয়নেটের আঘাতে বাবার শরীর রক্তাক্ত করেছিল, আমাদের সব টাকাপয়সা সোনা রূপো নিয়ে গিয়েছিল। আমাকেও হয়তো নিয়ে যেতো ক্যাম্পে, ধর্ষণ করতো মাসের পর মাস, বাধ্য করতো আত্মহত্যা করতে, কিন্তু বয়স আমার অল্প বলে আমাকে তুলে নিয়ে যায়নি। ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম সে রাতে। এখনও দুঃস্বপ্নের মতো একাত্তরের সেই মধ্যরাত।
অন্য বক্তারা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বললেন। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানকে মূল্য দিলেন সকলে। তা ঠিক। একই সঙ্গে, আমি মনে করি, পাকিস্তানকে আরও একটি জরুরি কাজ করতে হবে, রাষ্ট্র আর ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। ধর্মকে রাষ্ট্রের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলে রাষ্ট্র একদিন না একদিন মৌলবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়, সভ্য রাষ্ট্রে নয়।
সে রাতে মধ্যরাতে পাকিস্তানি আর্মিরা ঢুকেছিল বাড়িতে। কী করছিলাম আমি?
---‘ছটকু, আমার ছোট মামা, সেরাতে  মড়ার মতো ঘুমিয়েছিল। মাথায় বালিশ পড়তেই ছটকুর ঘুম এসে যায়। ও না ঘুমোলে নির্ঘাত চেঁচাত, আর ওরা ঠিক গুলি করে মারত ওকে, কেবল ওকে কেন, যারা ঘুমিয়ে ছিলাম ও বিছানায়– আমাকে, আমার ছোট বোন ইয়াসমিনকে, সবাইকে মারত। আমি অবশ্য ঘুমোইনি, ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম, যেন ঘুমের মধ্যে আমি তখন ঘুমরাজ্যের ঘুমপরীর সঙ্গে খেলা করছি, দোলনা দুলছি, যেন আমি আর মানুষের দেশে নেই, যেন আমি কিছুই টের পাচ্ছি না ঘরে অনেকগুলো বুট পরা লোক হাঁটছে, কাঁধে তাদের বন্দুক, তারা যে কোনও সময় হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে ইয়ার্কি করতে করতে গুলি করে মারতে পারে যে কাউকে, কেউ ঘুমিয়ে নেই জানলেই তার খুলি উড়ে যাবে গুলিতে, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে, ক্যাম্পে নিয়ে চাবকে চাবকে বেয়নেটের গুঁতোয় গুঁতোয় হাড়গোড় গুঁড়ো করা হবে। বুট পরা লোক যা খুশি করুক, তুমি ঘুমিয়ে থাকো মেয়ে, তোমার চোখের পাতা যেন না নড়ে, তোমার গা হাত পা কিছু যেন না নড়ে, হাতের কোনও আঙুল যেন না নড়ে, তোমার বুক যেন না কাঁপে, যদি কাঁপেই যেন বুকের কাঁপন ওরা, যখন মশারি তুলে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, টর্চের আলো ফেলবে তোমার ওপর, তোমার মুখে, তোমার বুকে, তোমার উরুতে, চোখ থেকে লালা গড়াবে, জিভ বেয়ে আগুন ঝরবে আর কথা বলবে এমন ভাষায় যা তুমি বোঝ না, টের না পায়। টের না পায় তোমার এক ফোঁটা অস্তিত্ব, টের না পায় তুমি আছ, তুমি জেগে আছ, যদিও তুমি আছ, জেগে আছ। যদি পায়ই টের, তবে যেন ওরা বলতে বলতে চলে যায়, তুমি কিশোরী হওনি, যুবতী হওনি, এখনও তোমার স্তন বলতে কিছু নেই। 

 

 

আমার গা বেয়ে ঠাণ্ডা একটি সাপ হাঁটছিল, সাপটি আমার গলা পেঁচিয়ে ছিল, আমার কষ্ট হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে, তবু আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম, টর্চের আলোয় আমার চোখের পাতা কাঁপতে চাইছিল, তবু আমি চোখের পাতা রাখছিলাম চোখের ওপর, ছটকুর ঠ্যাং একটি তোলা ছিল আমার ঠ্যাংয়ের ওপর, ঠ্যাংটিকে ওভাবেই পড়ে থাকতে দিচ্ছিলাম, আমার হাত একটি পড়ে ছিল ইয়াসমিনের পেটের ওপর, সেটিকে ইয়াসমিনের পেটের ওপরই পড়ে থাকতে দিচ্ছিলাম, কোলবালিশ ছিল আমার পিঠের পেছনে, সেটিকে পিঠের পেছনে দিচ্ছিলাম পড়ে থাকতে।

বুটজুতোর লোকগুলো দাঁড়িয়েছিল খাটের কিনারে, এক হাতে মশারি, আরেক হাতে টর্চ আর চোখগুলো জিভগুলো লালাঝরা আগুনঝরা আমার চুলে চোখে নাকে-কানে গলায় বুকে পেটে তলপেটে উরুতে ঠ্যাঙে পায়ে। ওদের গা থেকে গড়িয়ে ঠাণ্ডা সাপ সড়সড় করে নেমে এলো আমার শরীরে, সারা শরীর হেঁটে বেড়ালো, পিঠে পেটে তলপেটে, যৌনাঙ্গে, শুঁকল। সাপ ঢুকে গেল আমার মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর, রক্তে, মজ্জার ভেতর।

ওভাবে কতক্ষণ পড়ে ছিলাম আমি! কতক্ষণ ঘুমের মতো করে না ঘুমোনো মেয়ে! মনে হচ্ছে বছর পার হচ্ছে, ওরা তবু টর্চের আলো নিভোচ্ছে না, যুগ পার হচ্ছে তবু মশারি ছাড়ছে না হাত থেকে। মনে হচ্ছে, ঠাণ্ডা হয়ে হয়ে আমি মরে যাচ্ছি। হালকা হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর, কবুতরের গা থেকে ঝরা একটি পালকের মতো। আমি আর ঘুমে কাদা ছটকু আর ইয়াসমিনের মধ্যিখানে শোয়া নেই, আমাকে উত্তরে হাওয়া এসে নিয়ে যাচ্ছে চাঁদের দেশে। সামনে বুট পরা কেউ আর দাঁড়িয়ে দেখছে না, সবার নাগাল ছেড়ে আমি অন্য এক দেশে।

চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছে আর হাত নেড়ে আমাকে বলছে এসো হে এসো। ও চাঁদের বুড়ি গো আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে, জল দেবে? জল? চাঁদে তো জল নেই। কী বল, চাঁদে জল নেই! আমি যে তবে মরে যাব। তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। বুটের শব্দগুলো দূরে চলে যাচ্ছে, এ ঘর থেকে দূরে, আরেক ঘরে। চাঁদের বুড়ি বলে চোখ খোল মেয়ে, তুমি ঘামছ কেন শীতের রাতে! না বুড়ি আমি চোখ খুলব না, চোখ খুললে আমি আগুন দেখব আর লালা দেখব, ঠান্ডা একটি সাপ দেখব আমার গায়ে, আমি চোখ খুলব না। চোখ বুজেই ছিলাম, ইয়াসমিনের পেটের ওপর আমার হাত, আমার ঠ্যাংয়ের ওপর ছটকুর ঠ্যাং। 

দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির সূর, কে বাঁশি বাজায় এত রাতে। কে আমার ঘুম ভাঙাতে চায় অসময়ে, আমি আজ রাতে আর জাগবো না, শুনশান রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়, চোখ বোজো সকলে, ঘুমমেঘ তোমাদের ওড়াতে ওড়াতে চাঁদের দেশে নিয়ে যাবে, চাঁদের বুড়ি কোনও টুঁ শব্দ করবে না, চরকা কাটা ফেলে বুড়িও মেঘের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাবে।

এ আসলে বাঁশির মতো, বাঁশি নয়। এ আমার মা’র ফোঁপানো কান্না। মা কোথাও কাঁদছেন, ঘরে নয়, ঘরের বাইরে। মা সেই মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছেন, যে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন বাবা। রাসু খালু বলছেন, ‘না মরে নাই, বড়বু কাইন্দেন না, দুলাভাই মরে নাই’। রাসু খালু নারকেল গাছের পেছনে দু’হাত বাঁধা বাবার বাঁধন খুলে দিলেন আর তাঁর কাঁধ থেকে বাবার মাথা পিছলে গেল, পিছলে যেতে যেতে মাটিতে, ঘাসে, উপুড় হয়ে।

বাবার শরীরখানা টেনে ঘরে তোলেন তিনি। ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে প্রায় নিস্পন্দ শরীর, রক্ত ঝরছে মুখ থেকে, বুক থেকে, পেট থেকে’।

‘পাকিস্তানীরা আমাদের তিরিশ লক্ষ লোককে খুন করেছে, দু’লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব একটা ভুল ভাবনা, প্রমাণ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্ব একটা ভুল থিওরি।

পাকিস্তানিরা বাহান্নোতে আমাদের হত্যা করেছে, উনসত্তরে হত্যা করেছে, একাত্তরে করেছে। পাকিস্তানিদের নিয়ে আমার ভীষণ একটা ভয় ছিল, সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার মনে হতো পাকিস্তানের সবাই বোধহয় মন্দ লোক, সবাই মৌলবাদী, সবাই রক্ষণশীল, নারীবিরোধী। কিন্তু তা সত্য নয়। ভালো লোক ওখানেও আছে, বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী, মানববাদী  ওখানেও আছে। তারাই হয়তো একদিন দেশটাকে বাসযোগ্য বানাবে। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনও দেশকে আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব, তারপরও চেষ্টা করা ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই। 

প্রতিটি দেশেই মুক্তচিন্তকের সংখ্যা রক্ষণশীলদের সংখ্যার চেয়ে কম, পাকিস্তানেও ঠিক তাই। পাকিস্তানের মুক্তচিন্তক যুক্তিবাদীদের যেমন দেশটাকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তচিন্তকদেরও তাই করতে হবে। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে মাঝে মাঝে আমি কোনও পার্থক্য দেখতে পাই না’। 

লেখক: কলামিস্ট