আইসিসি, তাসকিন ও মাশরাফির কান্না

রায়হান মাহমুদরবিবার ভারতের হাই-টেক সিটি বেঙ্গালুরুতে প্রবাহিত হলো বাংলাদেশের কোটি কোটি ক্রিকেটামোদীর বুক ভাঙা বেদনার অশ্রু। মাশরাফি বিন মুর্তজা কাঁদলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগের সংবাদ সম্মেলনে! জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বলে কথা, 'কোড অব কন্ডাক্ট' বা আচরণবিধির জালে যে তিনি আগাগোড়া বাঁধা! তিনি যদি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক না হতেন আর না বসতেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আইসিসির নির্দিষ্ট করা আসনে, তাহলে হয়তো বেরিয়ে আসতো অনেক চমকপ্রদ তথ্য কিংবা ক্ষোভ। এদিন মাশরাফির চোখে অশ্রু শুধু বেদনার নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনতার ক্ষোভ আর হতাশাও।
মাশরাফি যখন বেদনায় নীল, তখন তাসকিনের কী অবস্থা? ২০০৯ সালে কেরানীগঞ্জে মাত্র ১৪ বছর বয়সে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে গিয়ে প্রথম ওভারেই দুই উইকেট নিয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন তাসকিন। এর আগে সিনিয়ররা খেলায় নিতে চাইতেন না। 'ছেলেটার বয়স অল্প, ও আমাদের লেভেলে খেলার যোগ্য হয়নি' এমনই ছিল তাদের মন্তব্য। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণিত করেছিলেন তাসকিন।
ম্যাচ শেষে ’খ্যাপ’ খেলার সম্মানী ছিল ২০০ টাকা। তাছাড়া দর্শকদের ২০/৫০/১০০ টাকার একাধিক নোটও উপহার পাওয়া সেই তাসকিন সাম্প্রতিককালে হয়ে ওঠেন বিশ্বের ক্রিকেট নয়নমনি।
সেই তাসকিনের ঘাড়ে যখন মাশরাফির 'পাগলা ঘোড়া' পেস আক্রমন ক্ষত-বিক্ষত করছে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের এমন সময়ই আইসিসি তাকে নিষিদ্ধ করলো। তার অপরাধ কী? কেন তিনি নির্বাসিত? সে উত্তরও অজানা। আইসিসির ব্যাখ্যায় নেই স্পষ্ট কোনও অভিযোগ। 'সাম অব হিজ অ্যাকশনস অয়্যার ফাউন্ড ইলিগ্যাল'  বলেছে আইসিসি। তাহলে তার শাস্তি কী সেটিতো আইসিসির ২.২.১৩ ধারায় স্পষ্ট  বলা আছে। এ ক্ষেত্রে বোলার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারবেন, তবে তাকে সতর্ক করা হবে। বিস্ময়করভাবে তাসকিনের ক্ষেত্রে আইসিসি এ নিয়ম মানেনি। কিন্তু কেন? তার কোনও সদুত্তর নেই।
তাসকিনকে কেন নির্বাসিত করা হলো তারও কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই আইসিসির। তার স্টক ও ইয়র্কার লেংথের ডেলিভারিতে কোনও সমস্যা নেই বলেছে আইসিসি। বাউন্সারে সমস্যা, তাও সবগুলিতে নয়, তাহলে অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট শেষে নিয়ম অনুযায়ী তাকে বলে দিলেই হতো যে, 'তুমি  এভাবে বাউন্সার দিলে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে'। সে সুযোগও তাকে দেওয়া হলো না।

অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে চারটিসহ মোট ১৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২১টি উইকেট নেওয়ার পর ও ১৩টি আন্তজার্তিক টি-টোয়েন্টি খেলার পর আইসিসির বোধদয় হলো তাসকিনের বোলিং অ্যাকশনে ত্রুটি আছে! বিস্ময়কর নয় কি?

 

 

কারও কারও অভিযোগ, আইসিসি নাকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নয়, এটি যেন ‌‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল’। তাসকিন  ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে সিরিজে ২০১৫ সালের জুন মাসে আট ওভারে ২৮ রান দিয়ে নিয়েছিলেন পাঁচটি উইকেট। তাহলে কি ভারতীয় ইনিংসকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার খেসারত দিলেন তাসকিন?

রবিবার পর্যন্ত ২২টি ম্যাচ হয়ে গেল চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে, শুধু আলো ছড়ানো আরাফাত সানি ও তাসকিনের ওপরই নজর পড়লো ভারতীয় আম্পায়ার সুন্দরম রবি ও রড টাকারের!  আর কোনও বোলারের অ্যাকশন রিপোর্টেড হলো না। ভারতের যশপ্রিত বুমরার হাত ডেলিভারি দেওয়ার সময় কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে থাকে তা জানার সাহস কোনও অন-ফিল্ড আম্পায়ার কি দেখাবেন? দেখালে তো চাকরি নট হওয়ার আশঙ্কা!

গুঞ্জন আছে আইসিসির কোপানলে পড়তে পারেন বাংলাদেশের আরেক পেস বোলিং সেনসেশন মুস্তাফিজও, তাকেও রিপোর্টেড করতে পারে আইসিসি। যদি এটি হয় তবে আর কোনও প্রশ্ন থাকবে না আইসিসির পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপারে।

একটি দলের শীর্ষ পেসার যখন হয়ে যান নিষিদ্ধ তখন দলের পুরো পরিকল্পনায় নামে ধস, তার শূন্য আসনে হঠাৎ করে কাউকে বসালে তো তার যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতিটা পূরণ হয় না, মনোবলেও ধরে চিড়। নিজেকে উজ্জীবিত করতে দলের প্রতিটি খেলোয়াড়কে দিতে হয় বাড়তি প্রচেষ্টা। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা তো মানুষ, তারা তো আর রোবট না যে তাসকিনের অভাবটা তাদের ভোগাবে না। ’স্পিরিট’ বলে যে কথাটা খেলায় প্রচলিত, যার ছোঁয়ায় একটি দল হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য সেটিই যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাসকিনের অভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যদি বড় ক্ষতি হয় তাহলে তার দায় নেবে কে?

 লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন