অন্ধকারে যুদ্ধ: বাংলাদেশে ওভারিয়ান ক্যানসার সংকট!

ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারকে প্রায়ই "নীরব ঘাতক" বলা হয়। কারণ এই ক্যানসারের লক্ষণগুলো কেউ পাত্তা দেয় না। বাংলাদেশে এই নীরবতা কানে তালা লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ওভেরিয়ান ক্যানসার কোয়ালিশনের একটি বৈশ্বিক গবেষণা— The Every Woman Study: LMIC Edition— ২৪টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে, নারীদের অভিজ্ঞতা ও কষ্ট তুলে ধরেছে। এই গবেষণার ফলাফল একদিকে উদ্বেগজনক, অপরদিকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার ডাক।

বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্যানসারজনিত মৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ ডিম্বাশয়ের ক্যানসার। এর ৭০ শতাংশের বেশি কেস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটে। ২০৪৫ সালের মধ্যে এই রোগে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে, অন্যান্য অনেক দেশের মতো, এই ক্যানসার এখনও যথাযথভাবে শনাক্ত হয় না, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নেই এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা অত্যন্ত কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২০ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২৩১ জন নারীর, যা দেশের মোট মৃত্যুর ০.৩১ শতাংশ। এ রোগে বয়স-সংশোধিত মৃত্যুহার প্রতি এক লাখে ৩.৩৪ জন, যা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে ১৩৩ নম্বরে ঠেলে দেয়।

এই গবেষণায় ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলের চিকিৎসকদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নির্মম বাস্তবতা। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নারীদের এই রোগের কণ্ঠস্বর শুনতে ব্যর্থ। অধিকাংশ হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডায়াগনস্টিক সুবিধা নেই। চিকিৎসা সেবা মূলত শহরকেন্দ্রিক, ফলে গ্রামের নারীদের ভোগান্তি ও ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যায়। আধুনিক চিকিৎসা যেমন টার্গেটেড থেরাপি কিংবা জেনেটিক টেস্টিং— একরকম নেই বললেই চলে।

রোগীরা সাধারণত হাসপাতালে আসেন তখনই যখন রোগ অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছে। এটি তাদের উদাসীনতা নয় — বরং সচেতনতার অভাব, সামাজিক কলঙ্ক, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং সিস্টেমের দুর্বলতার ফল। অনেক ক্ষেত্রে, নারীদের চিকিৎসার জন্য স্বামীর অনুমতি বা আর্থিক সহায়তা লাগে। এমনকি কেউ কেউ স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, যার ফলে চিকিৎসা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

করোনাভাইরাস মহামারি এই সংকটকে আরও গভীর করেছে, চিকিৎসা পেতে বিলম্ব ঘটেছে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

তবু, হতাশার মধ্যেও আশার আলো আছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, যারা এই রোগ থেকে বেঁচে ফিরেছেন, তারা হতে পারেন সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে স্থানীয় ডাক্তার ও নার্সরাও সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। পুরুষদেরও এই সচেতনতায় যুক্ত করতে হবে — শুধু সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে নয়, বরং নারীদের পাশে থেকে সহযোগী হিসেবে।

সরকার চাইলে বদল ঘটাতে পারে—অন্য অনেক দেশ ইতোমধ্যে সেই উদ্যোগ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উজবেকিস্তান ও জাম্বিয়ার মতো দেশগুলোতে সরকার সম্পূর্ণরূপে ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় বহন করে। বাংলাদেশেও এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ, জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি গঠন এবং গাইনোকলজিক অনকোলজি সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারণ।

ডিম্বাশয়ের ক্যানসার শুধু ঢাকার অভিজাত হাসপাতালের সমস্যা নয়— এটি একটি জাতীয় সংকট, যার সমাধান চাই তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা, কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

আজ, বিশ্ব ডিম্বাশয় ক্যান্সার দিবসে, আমাদের উচিত এই নীরবতাকে ভেঙে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া। এই দিনটি হতে হবে এমন একটি আহ্বান, যা সরকারের নীতিনির্ধারকদের বাধ্য করে নারীদের জন্য সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে, জাতীয় স্বাস্থ্য কৌশলে এই রোগকে অন্তর্ভুক্ত করতে, এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের জন্যও সুলভ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে।

প্রতীকী উদ্যোগ নয়, দরকার কার্যকর নীতি ও বাস্তবায়ন।

আজ না হলে কখন?

লেখক: পরিচালক, ওয়ার্ল্ড ওভেরিয়ান ক্যানসার কোয়ালিশন।