বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট একটি ভিন্নতর পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—এবার ‘মানুষের জন্য বাজেট’ বলেই একে অভিহিত করা হয়েছে। ‘জিরো দারিদ্র্য, জিরো বেকারত্ব ও জিরো কার্বন’—এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্র তার আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চায়, সেই প্রশ্নে এবারের বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম।
শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ: কতটুকু যথেষ্ট?
২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২.১ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৫ শতাংশ। যদিও অংকটি পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় সামান্য বেশি, তাও ইউনেস্কোর প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ বা জিডিপির ন্যূনতম ৪-৬ শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগের আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক কম। উল্লেখ্য, এবছরের অনুমিত জিডিপি হলো ৬২, ৪৪,৫৭৮ কোটি টাকা।
তিনটি বিভাগের মধ্যে বরাদ্দের চিত্র:
১. প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ: ৩৫,৪০৩ কোটি টাকা
২. মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ: ৪৭,৫৬৩ কোটি টাকা
৩. কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ: ১২,৬৭৮ কোটি টাকা
এই বরাদ্দে ইতিবাচক অগ্রগতি থাকলেও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার মানোন্নয়নে তা যথেষ্ট নয়। শিক্ষা মানে শুধু অবকাঠামো নয়; মানসম্পন্ন শিক্ষক, আধুনিক পাঠ্যক্রম, সৃজনশীল মূল্যায়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতিই হতে হবে মূল লক্ষ্য– যা একদিকে নীতি ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ গঠনে সহায়ক হবে অন্যদিকে মানবসক্ষমতা বিনির্মাণে সহায়ক হবে।
শিক্ষার গুণগত মান ও পাঠ্যক্রম সংস্কার
চলমান পাঠ্যক্রম সংস্কার প্রক্রিয়ায় সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় Outcome Based Education (OBE) মডেল প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রশংসনীয়। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যবই বিতরণ কেন্দ্রিক মানদণ্ড প্রাধান্য পাচ্ছে, যেখানে শিক্ষার্থীর দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ দক্ষতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের দিকটি উপেক্ষিত।
এছাড়া নতুন পাঠ্যবই বিতরণের সময়ানুবর্তীতা, ভুলত্রুটি সংশোধন এবং শিক্ষকের প্রস্তুতির ঘাটতি শিক্ষার গুণগত মানে প্রভাব ফেলছে। বাজেট বক্তৃতায় ৯ কোটিরও বেশি বই বিতরণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বই বিতরণের গুণগত পর্যবেক্ষণের বিষয়টি অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের বর্তমান কারিক্যুলাম কর্মজগতের চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয় তাই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শিক্ষার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ পেশায় প্রবেশগম্যতায় নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এজন্য এক্সেপেরেন্সিয়াল লার্নিং, এপ্রেনটিসশিপ ও ইন্টার্নশিপ কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য কার্যকর উদ্যোগসহ ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া লিংকেজ জোরদার করা প্রয়োজন।
শিক্ষকের মর্যাদা ও পেশাগত উন্নয়ন
শিক্ষার মান উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো দক্ষ, উৎসাহী ও উজ্জীবিত শিক্ষক। অথচ বাজেটে শিক্ষকদের জন্য বোনাস বৃদ্ধি ও গ্রাচুইটি সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত ঘোষণা থাকলেও শিক্ষকদের মানসম্মত জীবনধারণের ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দসহ কোনও নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়নি। গত দশ বছরে বেতন কাঠামো অপরিবর্তিত থাকায় শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছেন।
এছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শিক্ষক প্রশিক্ষণে বরাদ্দ ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো উন্নয়নের কোনও সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। ই-লার্নিং, শিক্ষক পোর্টাল, অনলাইন প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্মে সরকারি বিনিয়োগের তথ্যও নেই, যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ
বাজেটে কারিগরি শিক্ষায় ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য, প্রতিটি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। তবে বাস্তবায়নের গতি, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যক্রম আধুনিকীকরণ এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্তির অভাবে এই পরিকল্পনা ধীরগতিতে কার্যকর হচ্ছে।
এছাড়া নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে যে ‘নারী পলিটেকনিক’ স্থাপন পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, তার জন্য নির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতি ও জবাবদিহিতার কাঠামো নেই।
মাদ্রাসা শিক্ষা: অন্তর্ভুক্তি নাকি বিচ্ছিন্নতা?
মাদ্রাসা শিক্ষাকে সময়োপযোগী করতে কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে যেমন, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ এবং এমপিওভুক্তির উদ্যোগ। তবে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার সমন্বয়হীনতা, ধর্মীয় শিক্ষার আধিক্য এবং জীবনমুখী দক্ষতা অভাব শিক্ষার্থীদের মূলধারার বাইরে রেখে দিচ্ছে।
অতএব বাজেটে অন্তর্ভুক্তির নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমে দক্ষতা, প্রযুক্তি ও নাগরিক মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দরকার।
প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও শিক্ষায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
বাজেট বক্তৃতায় ৫ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাব স্থাপন এবং ৩৬,০২০ শিক্ষককে আইসিটি প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। তবে এ উদ্যোগে প্রযুক্তি ব্যবহারের নীতিমালা, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল দক্ষতা অন্তর্ভুক্তির সুস্পষ্টতা নেই।
‘স্কুল অব ফিউচার’ বা “Upazila ICT Training Centers” এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিতে স্থানীয় পর্যায়ে তদারকি, প্রশিক্ষক নিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণের পরিকল্পনা অপরিহার্য।
শিক্ষায় বৈষম্য ও অন্তর্ভুক্তি: বাস্তব চিত্র
সরকারি স্কুলের মান নিম্নমুখী হওয়ায় ধনী-দরিদ্র শ্রেণিভেদে শিক্ষার সুযোগ ও গুণগত মানে বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে। বাজেটে শহর ও গ্রামে বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, তবে শিক্ষকের মান, উপস্থিতি ও কার্যকর শেখার পরিবেশে খুব বেশি অগ্রগতি নেই।
উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় কোনও পরিষ্কার নীতিমালা উপস্থাপন করা হয়নি।
ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টি, শারীরিক ও মানষিক স্বাস্থ্য ও স্কুলে থাকা পরিস্থিতি
‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্প ১৫০ উপজেলায় শুরু করার কথা বলা হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। তবে এটি জাতীয় কর্মসূচিতে পরিণত করার প্রস্তাব বা সময়সীমা নেই। শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্যের যত্ন এবং নিরাপদ বিদ্যালয় পরিবেশ গঠনে ‘স্বাস্থ্যবান্ধব বিদ্যালয়’ ধারণাকে বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।
বরাদ্দকৃত অর্থ বিতরন ও বাজেট ব্যবহার সক্ষমতা
বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাসময়ে ছাড় করা বিষয়ক জটিলতা এবং বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতার কারণে প্রতি বছর শিক্ষাখাতের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বরাদ্দ অব্যয়িত থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার এ ঘাটতি পূরণ না করলে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়।
পরিশেষে: প্রস্তাবনা ও ভবিষ্যত ভাবনা
জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করলেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ, অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। এজন্য জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো ও পেশাগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় মানসম্পন্ন সংযুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব-নাগরিকত্ব, গণতন্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। একই সঙ্গে শিক্ষায় প্রতিবন্ধিতা, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, ভৌগোলিক, ও মানবসৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহ দূর করতে সমতা ভিত্তিক বরাদ্দ নীতি গ্রহণ করা জরুরি।
একটি উন্নত, মানবিক ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রকে সাহসী বিনিয়োগ ও সংস্কারের পথে হাঁটতেই হবে। বাজেট কেবল আর্থিক নথি নয়, এটি আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকারের প্রতিচ্ছবি—সেই প্রতিচ্ছবিতে শিক্ষা যেন কেন্দ্রস্থলে থাকে, সেটিই আমাদের নাগরিক দাবি।
লেখক: শিক্ষাগবেষক এবং উন্নয়নকর্মী
h.enamul@gmail.com