মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত প্রসঙ্গ: রেমিট্যান্সের বিকল্প উৎস গড়ার সময়

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের রিজার্ভ, ব্যাংকিং খাত এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে অসামান্য ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম উত্তপ্ত কেন্দ্রবিন্দু হলো মধ্যপ্রাচ্য। ইয়েমেন যুদ্ধ, লেবাননে সংঘর্ষ, সিরিয়া-ইরাক জটিলতা, গাজায় গণহত্যা এবং সর্বশেষ ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এ অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে। এই অস্থিরতার ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে যদি তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারণ মধ্যপ্রাচ্যেই আমাদের বিপুল সংখ্যক প্রবাসীদের অবস্থান।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যার ৮০ ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এসেছে। কিন্তু যদি এই অঞ্চলে যুদ্ধ বা দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা শুরু হয়, তাহলে প্রবাসীদের জীবিকা যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি দেশের বৈদেশিক মুদ্রায়ও বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। এমন বাস্তবতায় আমাদের এখন থেকেই কিছু বিকল্প বিষয় নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

একটি ঝুড়িতে সব ডিম রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, এই প্রচলিত কথাটি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ একচেটিয়া মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মাথায় রেখে এখনই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার শ্রমবাজার অনুসন্ধান করা জরুরি। মালয়েশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, বেলারুশ, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, ব্রাজিল, চিলি এমন আরও অনেক দেশ এখন দক্ষ ও অর্ধ দক্ষ কর্মীর সংকটে ভুগছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এই বাজারগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিক রফতানির নতুন সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত অনেক বাংলাদেশিই স্বল্পদক্ষ বা অদক্ষ। অথচ উন্নত দেশগুলোয় চাহিদা মূলত আধাদক্ষ ও দক্ষ কর্মীর। তাই বিদেশগামী কর্মীদের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা উচিত। ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, ওয়ারেল্ডার, নার্সিং, কেয়ারগিভার, হোটেল ব্যবস্থাপনা, আইটি ও ডিজিটাল মার্কেটিং- এই খাতগুলোতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুললে আমরা সহজেই নতুন শ্রমবাজার দখল করতে পারি। চুল কাটার প্রশিক্ষণও দেওয়া যেতে পারে। ইউরোপের বাজারে চুল কেটে যা আয় করা সম্ভব, সেটাও চিন্তার বাইরে।

বিদেশ নির্ভরতা যত বাড়ে, ঝুঁকিও তত বাড়ে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই হতে পারে টেকসই সমাধান। কৃষিভিত্তিক শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো সম্ভব।

শুধু শ্রমিক পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এখন আর যথেষ্ট নয়। আমাদের আইটি, অ্যাগ্রো প্রসেসিং, ওষুধ, চামড়া ও তৈরি পোশাক খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি আয় বাড়াতে হবে।

বর্তমানে ভারতের পর বাংলাদেশের আইটি ফ্রিল্যান্সাররাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রুপ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতির যথাযথ সহায়তা না থাকায় আমরা এখনও রফতানিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারিনি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সহজ পেমেন্ট গেটওয়ে, কর ছাড় এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর রফতানি খাত থেকে শত শত কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম আমাদের অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে।

যদি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অনিরাপদ হয়, তাহলে সেখানে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন। এই বিপুল জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশে উৎপাদন ও বিনিয়োগে নিয়োজিত করতে হবে। সরকার চাইলেই প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, বিশেষ করে হালনাগাদ আইনি কাঠামো, জমি বরাদ্দ, ব্যাংক ঋণ ও ট্যাক্স ছাড়ে প্রণোদনা দিয়ে। এতে একদিকে অর্থনীতির গতি বাড়বে, অন্যদিকে বিদেশফেরত কর্মজীবীদের হতাশাও কমবে।

দেশের অনেক পরিবার একমাত্র প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এখন থেকেই পরিবারগুলোকে বিকল্প আয়ের পথ খোঁজার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। স্থানীয় সরকার, এনজিও এবং গণমাধ্যম একযোগে কাজ করলে সমাজে সচেতনতার ঢেউ তুলতে পারবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করাও ব্যাপক হারে বাড়ানো জরুরি।

বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত থেকেই আমাদের অধিকাংশ রফতানি আয় আসে। অথচ চামড়া, ওষুধ, সিরামিকস, কৃষিপণ্য, হিমায়িত মাছ, হস্তশিল্প ও হালকা প্রকৌশল পণ্যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এই খাতগুলোকে উপযুক্ত পলিসি ও প্রণোদনার মাধ্যমে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কেবল তাদের রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যতের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেখানকার যুদ্ধ বা অস্থিরতা আমরা ঠেকাতে পারবো না, কিন্তু তার প্রভাব আমাদের ওপর কমানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি। এক্ষেত্রে সুদূরদর্শী নেতৃত্ব, সময়োপযোগী নীতি এবং জাতীয় সংহতি প্রয়োজন। কারণ আজকের প্রস্তুতি আগামীকালের বিপদে আত্মরক্ষার ঢাল হতে পারে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।