এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই দেশের একটিও। গত নভেম্বরে প্রায় এরকম একটা খবরই প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। এই খবর থেকেই জানা যায় এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রতিবেশী ভারতের আছে ৭টি আর পাকিস্তানের আছে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার পরেও এই ধরনের খবর-সংবাদ-তথ্য হতাশার অবশ্যই। তবে খবরটা যতটা হতাশার, বেদনার, কষ্টের, তারও অনেক বেশি লজ্জা আর আতঙ্কের, ভয়ের, শঙ্কার। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করার বিশাল কর্মযজ্ঞে যে মানুষগুলো ঢুকছে, তারা তাহলে কী নিয়ে যাচ্ছেন সাথে করে?
সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তালিকাটি কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং নামে পরিচিত। এই র্যাংকিংটা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত গবেষণা করা হয়। যে চারটি বিষয়ে প্রধানত তথ্য যাচাই করা হয় এর একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সুযোগ কতটা আছে। সম্ভবত এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবে খুবই কম নম্বর। গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আগ্রহ প্রায় নেই বললেই চলে। গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা বিষয়ে আলোচনার আগে একটা প্রশ্নের উত্তরে প্রবেশ খুবই জরুরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কি গবেষণার আসলে দরকার আছে?
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল কয়েকটি ভবন নয়, আর এর মূল লক্ষ্য শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, বরং নতুন জ্ঞান, চেতনা, ভাবনা, উদাহরণ তৈরি করা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান শুধু ভবন বা অবকাঠামো দিয়ে নির্ধারিত হয় না, হওয়ার কথাও নয়। শিক্ষাবিদ আর্নেস্ট বয়ার-এর কাছ থেকে ধার করে বলা যায় যে ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, মর্যাদা, গুরুত্ব বরং নির্ধারিত হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণার যে উদ্দীপনা ও আবেগ সৃষ্টি হয়, তার দ্বারা।’
ড. এ. পি. জে. আব্দুল কালামও বলেছেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদানের স্থান নয়, বরং তা হওয়া উচিত গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র।’
গবেষণা ছাড়া শিক্ষা হয়ে পড়ে একঘেয়ে ও বাস্তবতা-বিবর্জিত, অর্থহীন, অনেকাংশে অকেজো। অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে গবেষণা ও উদ্ভাবনের ইঞ্জিন। গবেষণা ছাড়া শিক্ষা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।’ আর নোয়াম চমস্কির মতে, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশের জন্য কৌতূহল এবং সমালোচনামূলক অনুসন্ধানের সংস্কৃতি অপরিহার্য। অনুসন্ধানী চেতনা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে।’ সুতরাং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় করে গড়ে তুলতে গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
এবার আরেকটা জরুরি প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক, আমাদের মতো দেশে গবেষণার জন্য এত খরচ করার কি দরকার আছে? প্রথমত একেবারে এককথায়, সুনির্দিষ্টভাবে, স্পষ্ট করে এর উত্তর হলো, দেশের ভবিষ্যৎ যদি তৈরি করতে চাই, গবেষণায় খরচ করতেই হবে। গবেষণার ব্যয় কিন্তু খরচ বা ব্যয় নয়, এটা বিনিয়োগ। নোবেল বিজয়ী স্যার পল নার্স বলেছেন, ‘গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় আসলে ভবিষ্যতের জন্য করা বিনিয়োগ।’ আর এই বিনিয়োগ কেন প্রয়োজন? উত্তর দিয়েছেন বারাক ওবামা। তিনি বলেন, ‘যেসব দেশ গবেষণা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ করে, তারাই ভবিষ্যৎ গড়ে।’
গবেষণার জন্য সরকারি তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থের অভাব-কথাটি বছর দশেক আগে হলেও কিছুটা বিশ্বাস করা যেতো। কিন্তু দেশের বিভিন্ন খাতে যে হারে, যেভাবে, যে পদ্ধতি সরকারি অর্থের ব্যয় হয়, অপচয় হয়, লুটপাট হয়, তাতে এই কথা আর ধোপে টেকে না। ছোট একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল হওয়ায় প্রশিক্ষণ বাবদ অপচয় হাজার কোটি টাকা’। এই শিরোনামে সংবাদটি গত নভেম্বরে প্রচারিত হয় একটি টিভি চ্যানেলের ওয়েবসাইটে। খুঁজলে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে।
এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার জন্য যে সরকারি বরাদ্দ পায়, তার কি সদ্ব্যবহার হচ্ছে? প্রায় সময়ই অভিযোগ করা হয় যে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারছে না। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় উল্টো আরেকটা তথ্য। গবেষণায় বরাদ্দ যা দেওয়া হয় তাও পুরোপুরি খরচ করতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৯ বছরে বাংলাদেশে গবেষণার জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ ১৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১২.১৬ কোটি টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য গবেষণায় সর্বোচ্চ ১৮৮.৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এসব অর্থ বরাদ্দের পরও গবেষণা খাতে উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরাদ্দের প্রায় ১৯ শতাংশ, ২০১৮-১৯ সালে ২৫ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে ১২ শতাংশ, ২০২০-২১ সালে ২৯ শতাংশ এবং ২০২১-২২ সালে ১৪ শতাংশ অর্থ খরচ হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২০ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ খরচ হয়নি।
গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনাগ্রহের চিত্র স্পষ্ট হয় তাদের বাজেট পর্যালোচনা করলেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি ১ হাজার ৩৫ কোটি টাকার যে বাজেট পেশ করেছে তাতে গবেষণায় বরাদ্দ করেছে মাত্র ২১.৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২.০৮ শতাংশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য মাত্র ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট বাজেট ৩২৩.৩৫ কোটি টাকার মধ্যে গবেষণার জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ২.৮৫ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গড় গবেষণা বরাদ্দ তাদের মোট ব্যয়ের ২ শতাংশেরও কম। বেতন-ভাতার জন্য ৬০ শতাংশেরও বেশি বরাদ্দ রেখে, এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের চেয়েও গবেষণায় কম বরাদ্দ রাখার এই প্রবণতার সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা অজুহাত দেখাবে, দেখায়ও। কিন্তু সেগুলো তলিয়ে দেখলে আসলে তেমন একটা কূল পায় না, পাওয়ার কথাও নয়।
গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অনীহা নতুন কিছু নয়, এটাও একটা বড় আতঙ্কের বিষয় হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৬০টিতে কোনও গবেষণা কার্যক্রমই হয়নি। এর মধ্যে ১২টি সরকারি এবং ৪৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। একই বছর ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও প্রকাশনা প্রকাশিত হয়নি, অর্থাৎ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষক কোনও জার্নাল, সাময়িকী বা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি। গবেষণা কার্যক্রমে অগ্রসর হওয়ার বদলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার বরাদ্দই রাখেনি। ২০টি বেসরকারি এবং ৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ওই বছর গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখেনি। ২০১৯ সালে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০টিতে গবেষণায় কোনও বরাদ্দই ছিল না। এর পরের কয়েক বছরে অবস্থার আরও খানিকটা অবনতি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদন বলছে ২০২২ সালে দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখেনি। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ওই বছর তুলনামূলকভাবে নতুন ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণায় কোনও বরাদ্দ ছিল না।
বলাবাহুল্য, গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আগ্রহী হয়ে উঠতে হবে। এর জন্য চাই পরিবেশ। অনেকে বলেন, গুণী শিক্ষক-ছাত্রও আজকাল গবেষণায় আগ্রহী হয় না। কারণ শিক্ষকের মূল যে কাজ, নিজে পড়াশোনা করা, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো আর গবেষণা– শুধু এগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে নাকি বৈষয়িকভাবে পিছিয়ে পড়তে হয় এ দেশে। বরং পড়াশোনার বাইরে, ক্লাসরুম থেকে দূরে, আর গবেষণার কাছ থেকে যারা যতদূরে থাকতে পারেন, লেজুড়বৃত্তির কাছাকাছি যারা থাকতে পারেন, তারাই নাকি বৈষয়িকভাবে লাভের মুখ দেখেন বেশি! দুঃখজনক হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই এর সত্যতা মিলবে, খুঁজলে।
সুতরাং আমাদের এখন জরুরি কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। গবেষণাকে জাতীয় কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাখতে হবে এর কেন্দ্রে। প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে, উদ্যোগটা আসলে আসতে হবে সেখান থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট বাজেটের অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ চাই গবেষণা খাতে। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার সার্বিক সংস্কার এখনই প্রয়োজন। একটি জ্ঞানভিত্তিক জাতি বিনির্মাণে এর কোনও বিকল্প নেই।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী। প্রধান- সামাজিক উন্নয়ন, আরডিআরএস বাংলাদেশ