ভয়ের সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যমের নীরবতা

২০ মার্চ। রাত তখন ১টা ৪৫ মিনিট। হঠাৎ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়লো- একটি হাসি-খুশি, মিষ্টি মেয়ের ছবির পাশে তার এক বন্ধু লিখেছে, ‘একটু আগেই তনুর সঙ্গে ইমোতে কথা হয়েছে... সেনানিবাসেও কেউ খুন হয়?’ বন্ধু হিসেবে তিনি কোনওভাবেই তা মেনে নিতে পারছেন না। আমিও আঁতকে উঠলাম, সেনানিবাসে? কীভাবে সম্ভব সেনানিবাসে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড?
হঠাৎ দেখলাম, একটি অপরিচিত অনলাইন পত্রিকা খবরটি অতি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। এরপর কিছু ‘জনপ্রিয়’ পত্রিকার অনলাইন দেখলাম, কিছুই পেলাম না! অপেক্ষা করলাম, নিশ্চয়ই দেবে, হয়তো সময় লাগছে। কিন্তু আর খবর মিললো না ওইসব পত্রিকার পাতায়!
ইতোমধ্যেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লো একটু-একটু করে। দেখলাম, তনু কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী। আমার কলেজের, শুনতেই যেন আরও বেশি কষ্ট হচ্ছিল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলাম আমি, তাই গুমোট কান্না পাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো কলেজের এই ছোট বোনটি আমার অতি চেনা, চিরচেনা। বুঝতে পারছিলাম না, কী করব?
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৩টা, কাউকে ফোন দিয়ে জানবো, তাও পারছি না। পরদিন আমার মায়ের কাছ থেকে কুমিল্লার কয়েকজন সাংবাদিকের নম্বর নিয়ে ফোন দেই। অনেকের ফোনই বন্ধ পাচ্ছিলাম(!)। অবশেষে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধিকে পেয়ে গেলাম। বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। তিনি একটা স্টোরি তৈরি করেছেন টিভিতে প্রচারের জন্য। কিন্তু তখন পর্যন্ত তনুর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। বাবা-মা এবং পুরো পরিবারকে মিডিয়া থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা চলছিল, এতটুকু বুঝতে পারলাম। বিষয়টা তখন আরও ঘোলাটে ঠেকলো। এত লুকোচুরির কী আছে? সিভিলরা এই ধরনের কাণ্ড করলে দেশ-বিদেশ জানতে পারে, সেনাবাহিনীর ভেতরে হওয়াতে এত লুকোচুরি? পরে আরও ২/৩ জন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়। সবাই প্রায় একই কথা বললেন। কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি যাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে খবরটি পেলাম, অর্থাৎ তনুর বন্ধুদেরও সবাইকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, একেবারেই দু’একজন ছাড়া।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না, এটা আমাদের এতদিনের সব অর্জনকে মাটিতে পিষে ফেলেছে, তাই পুরো তরুণ সমাজ জ্বলে উঠেছে আবারও। অপরাধী তো যে কোনও গোত্রেই থাকতে পারে, তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে কেন? খবরটিকে ‘খবর’ না করার সব চেষ্টাই যেন ব্যর্থ হলো, শেষ রক্ষা আর হলো না...
প্রতিবাদে কুমিল্লায় আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা নেমে পড়লেন রাস্তায়, বন্ধ হয়ে গেল সব রাস্তা ঘাট। হাজারও শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগ দিলেন সাধারণ জনগণ। উত্তাল কুমিল্লার সেই আন্দোলনের ভাষা ছড়িয়ে পড়লো সোশ্যাল মিডিয়ায়। তনুর বিচারের জন্য দাঁড়িয়ে গেল লাখো মানুষ। ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শাহবাগ, টিএসসি পর্যন্ত পৌঁছে গেল, সংঘবদ্ধ হলো তারুণ্য। কুমিল্লা আর শাহবাগ এক হয়ে আজ এ লড়াইয়ে নেমেছে, এই লড়াই আমাদের, আমাদের সবার।

তনু হত্যাকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে একইভাবে কতজন নারী নিপীড়িত-ধর্ষিত হচ্ছে বা হয়েছে, তা কেবল সেখানকার স্থানীয়দের মুখেই শোনা যাবে, আমাদের গণমাধ্যমে সেসব বিবরণ পাওয়া যায় না কখনওই! পাহাড়ে কিংবা সমতলে কল্পনা চাকমা থেকে শুরু করে তনু পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি।

আমেরিকার ‘সাদা বাড়িতে’ এই মুহূর্তে কী হচ্ছে, কাদের নিয়ে কী প্ল্যান করছে ওবামা প্রশাসন, তা যখন গণমাধ্যমের কল্যাণে বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের এক কৃষকও জানতে পারেন, সেখানে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর কথা বলা যাবে না- এই কলোনিয়াল (ঔপনিবেশিক) যুগের চিন্তাভাবনা নিয়ে যারা বসে আছেন, তাদের একটু ভাবনায় পরিবর্তন দরকার!

শহরগুলোতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ‘ভিন্ন শহরে’ তাদের বসবাস। মানি, নিরাপত্তা তাদেরও প্রয়োজন। কিন্তু  নিরাপত্তার নামে এই কলোনিয়াল যুগের সংস্কৃতি আমরা ‘সাধারণরা’ জন্ম থেকেই মেনে নিয়েছি বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। কেননা, আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে সেনাবাহিনীর প্রভুত্ব মেনে নিতে হয়। সেনাবাহিনীর কোনও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা দূরে থাক, মাথায় চিন্তাও আনা যাবে না! তাই আমরা বছরের পর বছর চুপচাপ মেনে নিই একই শহরে থাকা তাদের দাম্ভিক পদচারণা। এই দাম্ভিকতার আওয়াজে সহজেই অস্পষ্ট হয়ে যায় হাজারও আদিবাসী নারীর গোঙানীর শব্দ, ভুলে যাই কল্পনা চাকমাসহ আরও কত আদিবাসী নারীর নিপীড়নের গল্পকথা। এই ভুলে যাওয়াটা আমাদের ভয়ের সংস্কৃতিরই অংশ!

এই ভয়ের সংস্কৃতিতে আর কতদিন আমরা চুপ করে থাকবো? আজ বোধহয় সময় হয়েছে, এই ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার, প্রশ্ন তোলার, উত্তর চাইবার। যদি সেনাবাহিনী আমাদের বন্ধুই হয়ে থাকে, তবে কেন তাদের সঙ্গে আমাদের ভয়ের সম্পর্ক? কেন এত দূরত্ব?

যেহেতু কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে এখনও কিছু জানানো হয়নি, তাহলে এখন পর্যন্ত আপাতভাবে ২টি কথা ঘুরে-ফিরে আসছে- এক. বহিরাগত কেউ গিয়ে তাদের নাকের ডগায় এই পাশবিক কাজটি ঘটিয়েছে এবং বীরদর্পে বের হয়ে ‘সাধারণের’ মধ্যে মিশে গেছে! দুই. সেনানিবাসের ভেতরের কেউ এই জঘন্য কাজটি করেছে।

আমার অনুমান, দ্বিতীয় কথাটিই সত্য হয়ে আসবে। কিন্তু যারা এখনও ভাবছেন প্রথমটি প্রমাণ করতে পারলে এক পক্ষ বেঁচে যায়, আমি বলবো, নাহ... কোনওভাবেই বেঁচে যায় না।

প্রথম কিংবা দ্বিতীয়, যেটাই হোক না কেন, সেনানিবাসের ভেতরে এমন ঘটনা কখনওই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, ভেতরের বা বাইরের যেই করুক, নীরবে এত বড় যজ্ঞ চালিয়ে গেল, কেউ টের পেল না, এটা হতে পারে না। 

‘সাধারণ’ এই আমরা যদি রাষ্ট্রের সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ জায়গায় ধর্ষিত এবং খুন হই, তখন মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে, এই নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার প্রদর্শনী আসলেই কতটা ভঙ্গুর আর কতটা মিথ্যা দাম্ভিকতায় পূর্ণ!

ধর্ষক-খুনি কে বা কারা এবং কীভাবে বিচার হচ্ছে এই বিষয়টিকে ২০ হাজার টাকা আর এক খণ্ড জমি দিয়ে আড়াল না করে বরং সামনে এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা প্রয়োজন। তা না করে এখন যা করা হচ্ছে, তা করলে ওটা কার্পেটের নিচে ধূলা লুকানোর মতোই হবে, ময়লা যাবে না, বরং লুকিয়ে থাকবে। সময় মতো বের হয়ে আসবে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে, যা সামলানোর মতো ক্ষমতা হয়তো কারও থাকবে না।

আমাদের ভয়ের সংস্কৃতির আরেকটি রূপ প্রকাশ পেল গণমাধ্যমের নীরবতা দেখে! সাধারণত এই ধরনের ঘটনায়  গণমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ে বাজার কাটতির জন্য, রসিয়ে গল্প ‘নির্মাণ’ করে, কিন্তু তনুর ব্যাপারে একদম নীরব কেন?

সেনানিবাসের ভেতরে ঘটেছে বলে কোনও কোনও গণমাধ্যম চুপ করে পর্যবেক্ষণ করছিল প্রথম কিছুদিন, ময়লা কার্পেটের নিচে যথার্থভাবে লুকানো গেলে তারা হয়তো বিষয়টা চেপে যেত, তাই নীরব থেকে সর্বোচ্চ সহয়তা করেছে। কিন্তু ‘বেয়াড়া পোলাপানের’ জ্বালাময়ী চিৎকারে যখন আর লুকানো গেল না, তখনই হঠাৎ করে গ্রিন সিগনাল পেয়ে ধারাবাহিক লেখা/বলা শুরু হয়ে গেল। নব্য উপনিবেশবাদে গণমাধ্যমের চরিত্র যে এমন হবে, তা অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন স্টুয়ার্ট হল, চমস্কিসহ আরও অনেকেই। খবরটি চেপে রাখার জন্য কেন এই মৌনতা, কেন এত লুকোচুরি তা যে আমরা বুঝি না তা নয়। তবুও যদি ভয়ের সংস্কৃতি কাটিয়ে গণমাধ্যমের কর্তা ব্যক্তিরা তা স্বীকার করে নিতেন, তাহলে হয়তো তনুর আত্মা শান্তি পেত!

মার্কিন সেনাবাহিনীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে নৃবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক ড. ডেভিড ভাইনের একটি বই ‘বেইস নেশন’ (গতবছর নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার নির্বাচিত) পড়ে শেষ করলাম ক’দিন আগে। মার্কিন এই অধ্যাপক তার গবেষণার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, কী করে মার্কিন সেনাবাহিনী দিনের পর দিন খোদ যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পৃথিবীর ক্ষতি করে চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে কলিন পাওয়েল সেনাপ্রধান থাকার সময় তার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা-পর্যালোচনা নিয়ে যে কত বই আছে, তার হিসেব নেই। ওয়াশিংটনে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, সেখানে একটি ছাত্র সংগঠন কলিন পাওয়েলকে একবার নিয়ে এলো দাওয়াত করে। ক্যাম্পাসের ভেতরে ইনডোর স্টেডিয়ামের মঞ্চে কলিন পাওয়েল বসা, চারপাশে হাজারও মার্কিন শিক্ষার্থী বসে আছে। শিক্ষার্থীদের একে একে প্রায় ৩০ জন প্রশ্ন করলেন, তিনি উত্তর দিলেন ঘণ্টা দুয়েক ধরে। সেনাবাহিনী প্রধান থাকাকালে ইরাকের বিরুদ্ধে তার বিতর্কিত ভূমিকা, বুশ প্রশাসনে তার বিতর্কিত সিদ্বান্ত গ্রহণ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি প্রসঙ্গ হতে শুরু করে নানা ধরনের জবাবদিহিমূলক প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

একই মঞ্চে গত ৫ বছরে এসেছিলেন মিশেল ওবামা, হিলারি ক্লিনটন, কন্ডোলিৎসা রাইস, ক্লিনটনসহ আরও অনেকেই। আমি ছাত্র সংগঠনটির বন্ধুদের অবাক হয়ে বললাম, তারা আমাদের ডাকে চলে আসেন ছাত্রদের সামনে কথা বলতে এবং শুনতে? আমার প্রশ্নে পাল্টা ওরা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন নয়? পারস্পরিক মতের আদান-প্রদান না হলে দেশ গড়ে উঠবে কী করে? আর পারস্পরিক সম্পর্কইবা তৈরি হবে কীভাবে? তাদের জবাবদিহিতা থাকার প্ল্যাটফর্ম তো আমরাই তৈরি করব, আমরা তরুণরা না করলে, কে করবে?’

ভাবছি আমাদের এই সংস্কৃতি কবে গড়ে উঠবে? দেশ যারা পরিচালনা করেন- সরকার, সেনাবাহিনী, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক- যে যার জায়গা থেকে যদি জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে প্রবেশ করি, তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। বিশেষ করে সেনাবাহিনী আমাদের বন্ধু, আমাদের শত্রু নয়- এটা তারা বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে অনেকবার প্রমাণ করেছেন। কেবল পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সুতোর গাঁথুনি নেই, তাই তৈরি হয়েছে বিশাল দূরত্ব। জবাবদিহিতার সংস্কৃতিই পারে নানা ভয় কিংবা দূরত্বকে দূর করতে। আমরা মোম জ্বালিয়ে আজ স্বাধীনতা উদযাপন করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মোমের নিচে যে অন্ধকার, সে তার সমস্ত আলো দিয়েও আলোকিত করতে পারে না। তেমনি যতদিন আমরা ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে কথা না বলতে পারবো, যতদিন এই উপনিবেশিক মনোভাব মনে পোষণ করে একই সমাজে দেয়াল তৈরি করবো, যতদিন একজন নারীর নির্যাতনকে নিজের শরীর দিয়ে বিবেচনা না করবো, ততদিন আসলে বাতির নিচের অন্ধকারের মতোই আমাদের সব অর্জন অন্ধকারেই থেকে যাবে।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়