কিন্তু সীমান্ত পরিস্থিতি কোনোভাবেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সমান্তরাল নয়। সম্পর্ক যতটা উষ্ণ, সীমান্ত যেন ততটাই উত্তপ্ত। বিশ্বের সব দেশের সীমান্তেই কোনও না কোনও সমস্যা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চেয়ে বিপজ্জনক সীমান্ত বিশ্বের আর কোথাও নেই। এমনকি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের স্থলসীমান্ত আছে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারের সঙ্গে; আর সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মতো এমন মৃত্যুফাঁদ আর কোথাও নেই। ২০১৭ সালে নেপাল সীমান্তে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় ভারতকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমা চাইতে হলে ভারত দম ফেলার সময় পেতো না। সম্পর্কের সর্বোচ্চ উচ্চতার এই ১১ বছরেই সীমান্তে মারা গেছে সাড়ে ৩শ’রও বেশি মানুষ। এই বছরের প্রথম মাস এখনও শেষ হয়নি, মৃতের সংখ্যা ১৫-তে পৌঁছেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ৪৩ বাংলাদেশি মারা গেছেন। অথচ আগের বছর এই সংখ্যা ছিল তিন ভাগের এক ভাগ, ১৪ জন।
২০১১ সালে কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত কিশোরী ফেলানির কাঁটাতারে ঝুলে থাকা লাশ নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক হইচই হয়েছে। তখন বিএসএফ-এর পক্ষ সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। বিএসএফ বলেছিল, সীমান্তে তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না। ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকেও সীমান্তে প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বরং মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিবছরই বেড়েছে।
অনেকে বলছেন, বিএসএফ তো নিরীহ বাংলাদেশিদের গুলি করছে না। যারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বা চোরাচালান করতে যায় বিএসএফ শুধু তাদেরই গুলি করে। কিন্তু অবৈধভাবে গেলেই গুলি করতে হবে কেন? বিএসএফ তো চাইলে তাদের আটক করতে পারে বা প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া শুধু গুলি করে নয়, বিএসএফের হাতে নির্যাতনে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। তার মানে বিএসএফের লক্ষ্য পরিষ্কার। তারা হত্যাই করতে চায়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সঙ্গে সীমান্ত পরিস্থিতির কোনও মিল নেই। তারচেয়ে বড় কথা হলো—চোরাচালান তো শুধু বাংলাদেশিরা একা করে না। ভারতীয়রা তো এতে জড়িত। ভারতের গরুগুলো তো একা একা হেঁটে হেঁটে সীমান্তে আসে না। নিশ্চয়ই ভারতের কেউ নো কেউ গরু বা অন্যান্য পণ্য সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। বিএসএফ তাদের ধরে না কেন? বাংলাদেশের বাজারের জন্য ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় ফেনসিডিল কারখানা গড়ে ওঠার খবরও তো সবার জানা। সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশিদের মারার আগে ভারত সরকারের উচিত তাদের দেশের চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
তবে, সাধারণ মানুষের কথা ধরে লাভ কী? সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি নওগাঁর পোরশা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হন। এই এলাকার সংসদ সদস্য খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এই হত্যার ঘটনায় তার ক্ষোভে ফুঁসে ওঠার কথা। নিজের এলাকার মানুষকে রক্ষা তার দায়িত্ব। কিন্তু ঘটেছে উল্টো ঘটনা। সাধন চন্দ্র মজুমদার বরং বিএসএফের হত্যার পক্ষেই যুক্তি দিয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘আসলে আমাদের চরিত্র যদি ভালো না হয়, পরের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেউ যদি জোর করে কাঁটাতারের বেড়া কেটে গরু আনতে যায় আর ইন্ডিয়ার গুলি খেয়ে মারা যায়, তার জন্য দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নেবে না।’ তার বক্তব্য শুনে আমি বিস্ময়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, সাধন চন্দ্র মজুমদার আসলে কোনও দেশের মন্ত্রী। নিজের এলাকার মানুষের জন্য যার প্রাণ কাঁদার কথা, সেই তিনিই কিনা ভারতের হত্যার পক্ষে সাফাই গাইছেন। খাদ্যমন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার এলাকার মানুষ অবৈধভাবে সীমান্ত এলাকায় যায় কেন, তারা কেন চোরাচালান করে, কেন ভারত থেকে গরু আনে? মানুষ নিশ্চয়ই আর কোনও উপায় না পেয়ে পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তে যায়। তার মানে আপনি আপনার নির্বাচনি এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নত করতে পারেননি। ব্যর্থতাটা আসলে আপনার। বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী বা বিএসএফ যাই বলুক, সীমান্ত এলাকায় মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ অবৈধ কিছু করলে তাকে আটক করে আইনের হাতে তুলে দেওয়াই তাদের কাজ, গুলি করে মেরে ফেলা নয়।
শুরুতেই গত এক যুগে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন উচ্চতার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সম্পর্কের এই উচ্চতার সঙ্গে সীমান্তে হত্যার পরিসংখ্যান বড্ড বেমানান। বন্ধুত্বের উষ্ণতা রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশের একার নয়। বন্ধুত্বটা যদি কেউ মিন করেন, তাহলে এক্ষুনি সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতি চাই। সীমান্ত হোক শূন্যমৃত্যুর এবং সবার জন্য নিরাপদ।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ