এজাহার থেকে নাম তুলে নিতে সাঁওতালদের হুমকি এমপি সমর্থকদের

Gaibandha Sugar Mill FLOUP (Saotal) -1(03.12.2016)সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের বসতি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় স্থানীয় এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের নাম অর্ন্তভুক্ত করে থানায় এজাহার দাখিল করার পর অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন সাঁওতালরা।

সাঁওতালরা জানান, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মুখে নিরাপত্তার কথা বললেও হামলার পর প্রায় এক মাসেও গ্রামের পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের লোকজন দিনরাত টহল দিচ্ছে মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই সংসদ সদস্যের সমর্থকসহ বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন এজাহার থেকে এমপির নাম প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি সাঁওতালদের হুমকি দিচ্ছে।

Gaibandha Sugar Mill FLOUP (Saotal) -4(03.12.2016)আজ  (শনিবার) সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মাদারপুর গ্রামের গির্জার সামনের খোলা মাঠে কেউ কলাগাছের পাতা দিয়ে  ছোট্ট কুঠুরি বানিয়ে,  কেউবা  ত্রাণের পাওয়া তাঁবু টানিয়ে কোনও রকমে ঠাঁই নিয়েছেন। অনেকে থাকছেন পরিত্যক্ত স্কুলঘরে খড় বিছিয়ে। মাঠে মাটিতে গর্ত করে শতাধিক চুলা বানানো হয়েছে। যেখানে ত্রাণ পেলে রান্না করা হয়। নয়তো এসবের বেশির ভাগ আগুনের উত্তাপ পায় না। তবে শনিবার থেকে খামারে পুলিশি পাহারায় সাঁওতালদের চাষ করা ধান দ্বিতীয় দফায় কাটা শুরু হয়েছে। শনিবার মাড়াইয়ের পর ৫০ বস্তা ধান সাঁওতালদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাদারপুর গ্রামের বারনাবাস টুডু জানান, গত সোমবার (২৮ নভেম্বর) উত্তরাঞ্চলজুড়ে আদিবাসীদের ডাকা প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসেবে গাইবান্ধার মানববন্ধনে অংশ নিতে বাধা ও হুমকির পর থেকে সাঁওতালদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, ‘এখনও মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম দুটি ঘিরে রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজন। তাদের কাজ সাঁওতালদের বাইরে যেতে বাধা দেওয়া ও অন্য কাউকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়া।’ ফলে প্রায় এক মাস ধরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তারা।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন জানান, সাঁওতালদের পক্ষে থোমাস হেমব্রম বাদী হয়ে ২৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ থানায় এজাহার দাখিল করার পর থেকে দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই এজাহার থেকে এমপির নাম প্রত্যাহারের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে এমপির লোকজনরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি সাঁওতালদের হুমকিও দিচ্ছে।’

গত ৬ নভেম্বর সাঁওতালপল্লীতে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নেওয়া কোমল ফুলমতি মুরমু (৫৫) বলেন, ‘ওই দিন আমার কাঁথা-বালিশ-তোশক সব পুড়ে গেছে। দুটো মুরগি ও একটা ছাগল ছিল তা লুট হয়ে গেছে। এখন চাল নাই, চুলো নাই। কেউ দিলে খাই, না দিলে খাই না।’

মধ্যবয়সী তাসলিমা অভিযোগ করে বলেন, ‘ওরা একটুও সময় দেয়নি। প্রথমে গুলি, তারপর আগুন। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরবাড়ির মালামাল লুট হয়ে যায়। গরু-ছাগল পুড়ে অঙ্গার হয়েছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই। এখন এই খোলা মাঠে কেউ কিছু দিলে খাওয়া হয়, না দিলে অভুক্ত দিন কাটে। ছেলে আনিস ও স্বামী বেলাল হোসেন দিনের বেলায় পালিয়ে থাকে।’

নিরাপত্তার কথা তুলতেই সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দা রুমিলা কিসকু বলেন, ‘পুলিশরাই আমাদের গুলি করছে। আগুন জ্বালায়া দিছে। যখন আগুন লাগে, তখন আমি এখানে দাঁড়ায়া দেখতেছিলাম। প্রশাসনের লোকেরা এবং পুলিশ প্রথমে আগুন দেয়, পরে গুলি চালায়। আর এখনও আমাদের ওই দিকে যাইতে দেয় না। এত দিনেও আমরা ওই দিকে যাইতে পারিনি। আপনারা আসছেন বলে এইখানে (মাঠের পাশে) দাঁড়াইতে দিছে। না হলে গালি দিয়ে সরাই দিত।’

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ জানান, ঘটনার দিন তিনি এলাকায় ছিলেন না। এছাড়া এক প্রশ্নের জবাবে জানান, তিনি ব্যাপক ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে এলাকার লোক ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে কে কখন কাকে হুমকি কিংবা বাঁধা দিচ্ছে এটা তিনি জানেন না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সাঁওতালদের ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।

এ ব্যাপারে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘সাঁওতালদের চলাচলে কোনও বাধা নেই। এ ধরনের কোনও অভিযোগও আমার জানা নেই।’

প্রসঙ্গত, সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তোলে।

কিন্তু সম্প্রতি চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওইসব জমি লিজ দিলে তাতে ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়। ফলে প্রায় দুই বছর আগে সাঁওতাল ও স্থানীয় কিছু বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান চিনিকলের বিরুদ্ধে অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনে তাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে চলতি বছরের ১ জুলাই সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে বসতি স্থাপন করে। এবং ওই খামারের ১০০ একর জমিতে ধান এবং প্রায় ৮০০ একর জমিতে মাসকালাই, সরিষা ও পাট চাষ করে। বাকী জমিতে ছিল মিলের আখ ক্ষেত। গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের ওই খামারের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। পরে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এসময় তীরবিদ্ধ হন ৯ জন পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হন চারজন সাঁওতাল। তিনজন সাঁওতাল মারা যান। এছাড়া উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হন।

এই ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে ঘটনার  রাতে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে ৩৫০ জনকে আসামি দেখিয়ে মামলা দায়ের করেন। এরপর পুলিশ চারজন সাঁওতালকে গ্রেফতার করেছিল। তবে তারা জামিন পেয়েছেন।

অপরদিকে গত ১৬ নভেম্বর স্বপন মুরমু বাদী হয়ে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে সাঁওতালদের পক্ষে মামলা করেন। এ মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে।

এরপর গত ২৬ নভেম্বর দুপুরে সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত থোমাস হেমব্রম বাদী হয়ে স্থানীয় এমপি, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন।

 

/এমডিপি/এএআর /