সাতক্ষীরায় শহীদ স্মৃতিফলকে রাজাকার-অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম

 

কালেক্টরেট চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মাণ স্মৃতিফলক১৯৭১ সালে হাসানুজ্জামান ইসলামের বয়স ১৬ কিংবা ১৭ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা স্বাধীন হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ জেলাটি নাকি এখনও স্বাধীন হয়নি বলে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন রণাঙ্গনের বীর সেনানি হাসানুজ্জামান ইসলাম।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাতক্ষীরা স্বাধীন হলে শহীদদের স্মৃতিফলকে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকবে কেন? ২০০৫ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন কালেক্টরেট চত্বরে জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এ স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হলেও আজও তা উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি।’

স্মৃতিচারণ করে হাসানুজ্জামান ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি মাত্র এসএসসি পাস করেছি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে জুনে দেশে ফিরি। এরপর সাতক্ষীরার বালিয়াডাঙ্গায় সাব সেক্টর কমান্ডার মাহববুব উদ্দিনের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বেশ কয়েকন গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু স্মৃতিফলকে তাদের নাম না রখে অমুক্তিযোদ্ধা বা মানবতারবিরোধী অপারাধীদের নাম রাখা হয়েছে। যা আমাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক।’

কালেক্টরেট চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মাণ স্মৃতিফলকতিনি আরও বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও জজকোর্ট চত্বরে ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক। এ ফলকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বসানোর জন্য একই বছরের ৯ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩১ জনের একটি নামে তালিকা সাতক্ষীরার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে পাঠায়। সেই তারিকা অনুযায়ী নাম বসানো হয়। যেখানে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্থান পেয়েছে।’

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাবু ও ডেপুটি কমান্ডার শফিক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ফলকে যাদের নাম বসানো হয় তাদের মধ্যে কলারোয়ার বাগডাঙ্গা গ্রামের গোলাম রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও রাজাকার ছিলেন। এছাড়ও আশাশুনির রফিকুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হক এবং তালার সৈয়দ আবুল হোসেন দেদার বখত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। ফলে স্মৃতিফলক নির্মাণের ১১ বছর পরও ক্ষোভ আর ঘৃণায় কোনও মুক্তিযোদ্ধা এখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন না। আর যতদিন এটি সঠিকভাবে সংস্কার করা না হবে ততদিন সেখানে কোনও মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন না। তবে ২০১২ সালে স্মৃতিফলক থেকে রাজকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুছতে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গিয়েছিলেন।’

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্মৃতিফলক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর উদ্দেশে তৈরি করা। কিন্তু সাতক্ষীরার এ স্মৃতিফলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়বিরোধী রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধার নাম আছে। অথচ ১৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম স্মৃতি ফলকে স্থান পায়নি। তাদের মধ্যে রয়েছেন- এ বি এম নাজমুল আবেদীন খোকন, মুনসুর আলী, আব্দুস সামাদ, আব্দুর রহমান, শাহাদাৎ হোসেন, আব্দুল ওহাব, গোলজার আলী, জাকারিয়া, নূর মোহাম্মদ, সোহরাব হোসেন, আবু দাউদ বিশ্বাস, নূল ইসলাম কারিগর, সুবেদার ইলিয়াস খান, আবুল কালাম আজাদ, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ, মো. মোজাম্মেল হক ও মো. ইউনুস আলী।’

কালেক্টরেট চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মাণ স্মৃতিফলকজানা গেছে, ১২ লাখ ৪৬ হাজার ৭শ’ টাকা ব্যয়ে ২০০৫ সালের মে মাসে এ ফলকের নির্মাণ কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। একই বছরের ডিসেম্বেরে কাজ শেষ হলেও সেটি এখনও উদ্ধোধন করা হয়নি। ফলে স্মৃতিফলকটির দেখভাল না করায় নষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিফলকে নাম সংশোধনীর জন্য অনেক আন্দোলন ও স্মারকলিপি দেওয়া হলেও কোনও কাজে আসেনি।

ডেপুটি কমান্ডার শফিক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্মৃতিফলকে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাখা স্থান পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই কষ্টের। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি স্মৃতিফলক থেকে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দিয়ে সেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যুক্ত করা হোক।’

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। স্মৃতিফলকে নাম থাকা কয়েকজনকে রাজাকার দাবি করা হলেও তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তাই যতক্ষন পর্যন্ত তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা তাদের নাম মুছে ফেলতে পারি না। তবে বিষয়টি অবহিত করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আজও আমরা চিঠির জবাব পায়নি। সরকার বিষয়টি মীমাংসা না করলে এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না।’

/এসএনএইচ/