‘এসে ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী মুক্ত ঘোষণা করি’

তৈয়বুর রহমানরাজশাহী মুক্ত দিবস ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয়েছিল। রাজশাহীর অবরুদ্ধ মানুষ এ দিন নেমে এসেছিলেন রাজশাহীর মুক্ত বাতাসে। আর ওইদিন তারা তাদের হারানো স্বজনদের খুঁজতে ছুটে গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে এবং সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল নির্যাতিত বাঙালির লাশ ও বিবস্ত্র নারীদের। তাই মুক্তি পেলেও তার সঙ্গে ছিল গভীর বিষাদও। যা বাঙালি জাতিকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। রণাঙ্গন ফেরত এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা বাংলা ট্রিবিউনকে শোনাচ্ছেন সেই সময়ের গল্প। যা একইসঙ্গে বীরত্বের ও বিষাদের।

তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান। বর্তমানে তিনি রাজশাহী স্থানীয় একটি দৈনিক সোনালী সংবাদে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। রাজশাহীর গোদাগাড়ী হাইস্কুল থেকে সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। ২৫ মার্চের আক্রমণের পর তারা সবাই মিলে পাক আর্মিদের ব্যারিকেড দিতে গোদাগাড়ীতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এরই অংশ হিসেবে ২৭ মার্চ গোদাগাড়ীতে ইপিআররা বিদ্রোহ করে। গোদাগাড়ীর বিভিন্ন জায়গা কর্মরত পাক আর্মিদের ধরে এক জায়গায় উপস্থিত করা হয়। এদের মধ্যে থেকে কয়েকজন পালিয়ে ভারতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ২৮ মার্চ তৎকালীন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন গোদাগাড়ীতে আসেন। ইপিআরের নেতৃত্বে মুক্তিকামী মানুষসহ তারা গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এরপর গোদাগাড়ী থেকে পাঞ্জাবদের হটিয়ে তারা রাইপাড়া বাগানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তখন সবাই মিলে রাজশাহী সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত সেনানিবাস অবরুদ্ধ ছিল।

১৩ এপ্রিল পাকিস্তান আর্মির একটি বড় দল সাঁজোয়া যান সহযোগে রাজশাহী শহর দখল করে নেয়। এসময় তারা বহু মানুষ হত্যা করে ও বাড়িঘর দোকানপাট আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। রাজশাহী থেকে পিছু হটে গোদাগাড়ীর সিএনবি মোড়ে আবার অবস্থান নেয় মুক্তিকামী মানুষ। পাকিস্তান আর্মি শতাধিক গাড়ি সহযোগে রাস্তার দুধারে গুলি বর্ষণ করতে করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অভিমুখে রওনা দেয়। তখন বাধ্য হয়ে তাদের পিছু হটতে হয়। এসময় বেশিরভাগ তরুণরা ভারতে এসে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। তরুণ তৈয়বুর মা-বাবাসহ ভারতের তারানগরে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানকার নিরাপদ আশ্রয় তাকে টানে না। তিনি বুকে দুরন্ত প্রত্যয় নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ২১ এপ্রিল ভারতের লালগোলা ক্যাম্পে রিপোর্ট করে লালগোলা হাই মাদ্রাসায় প্রথম ইপিআরের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। ১ মে পর্যন্ত ওখানেই প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বিহার রাজ্যের চাকুরিয়া সেনানিবাসে যান তিনি। চাকুরিয়ায় জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে লালগোলা থানার শেখালীপুর ক্যাম্পে তাদের পাঠানো হয়। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর ধুলাউড়ি ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে প্রথম অপারেশনে পাঠানো হয় জুনের শেষ দিকে। রাজশাহী শহরে তিনটি দলকে পাঠানো হয় বিদ্যুৎ অফিস, সার্কিট হাউস ও ডিসি অফিসে আক্রমণ করার জন্য।

সাংবাদিক তৈয়বুর রহমান বলেন, আমাদের দলের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় বিদ্যুৎ অফিস আক্রমণ করার জন্য। সে উদ্দেশ্যে আমাদের পাঁচজনের একটি দলকে জহুরুল হক স্বপনের নেতৃত্বে পাঠানো হয়। আমরা চারদিন চাররাত হেঁটে গোদাগাড়ী উপজেলার রাজবাড়ীর প্রেমতলী হয়ে ঈশ্বরীপুরের আদিবাসী পল্লীতে পৌঁছাই। ওখান থেকে গোয়ালপাড়া আশ্রয় নিই। গোয়ালপাড়া থেকে রাতে হেঁটে দামকুড়া হাটে এসে অবস্থান নেই। তারপরে দিন রাতে শিলিন্দা-বসুয়া হয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেতর দিয়ে হেতেমখাঁ সবজিপাড়া এসে বিদ্যুৎ ভবনের চারপাশে অবস্থান নিয়ে পাঁচজনে গ্রেনেড চার্জ করি। সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিদ্যুৎ ভবনে আগুন জ্বলে উঠে। পুরো শহরে অন্ধকার নেমে আসে। রাস্তায় আর্মিদের গাড়ি হুইসেল দিতে দিতে দৌড়াতে থাকে। আমরা দামকুড়াহাট হয়ে গোয়ালপাড়ায় ফিরে আসি। ওখান থেকে গোলায় আশ্রয় নিই। গোলায় থেকে শীতলা রেলব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এর মধ্যে আরেকটা গেরিলা দল শীতলাই ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। পাক আর্মিরা আক্রমণ করতে পারে এমন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা গোলায় থেকে সরে গিয়ে মালিগাছিতে আশ্রয় নিই। আমরা সরে আসার পর পাক আর্মিরা গোলায় আমাদের আশ্রয়দাতাসহ নিরীহ মানুষদের নির্যাতন করে ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

সঙ্গীত শিল্পী তৈয়বুর রহমান বলেন, মালিগাছি থেকে আমরা তানোর ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকি। সে উদ্দেশ্যে আমরা গেরিলা কমান্ডার শফিকুর রহমান রাজার নেতৃত্বে পাঁচন্দর হয়ে গোল্লায় পাড়া থানার পাশে আশ্রয় নিই। ওখানে আমরা রাতে পুঁটি মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। পাক আর্মিরা জানতে পেরেছে এবং যেকোনো সময় আক্রমণ হতে পারে এই রকম তথ্যের ভিত্তিতে ওই অবস্থায় ওখান থেকে সরে পড়ে তানোরের ইয়াছিনপুর শান্তি কমিটির বাসায় আশ্রয় নিই। আমরা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাসায় রাজাকারের বিশেষ দল বলে আশ্রয় নিই। বলি- মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানান জন্য আমাদের পাঠানো হয়েছে। রাতে ওই শান্তি কমিটির নেতাকে গুলি করে মেরে ফেলে মালিগাছিতে ফিরে আসি। ওখান থেকে আবার ভারতের ধুলাউড়ি ক্যাম্পে গিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ১০/১৫ দিন পর তানোর হয়ে মোহনপুরের গোপালগঞ্জের কেশরহাটে সাঁকোয়া ক্যাম্পে আক্রমণ করি। আক্রমণে প্রায় দেড়শ জনের মতো রাজাকার পালিয়ে যায়। ১৩ জনকে আটক করি। পরে রাতে ১৩ জনকে মেরে ফেলা হয়। ওখান থেকে ধুরইল গ্রামে গিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে মেরে ফেলা হয়। তারপর ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে আগস্ট মাসের শেষের দিকে অভায়া ব্রিজ আক্রমণ করি। সেখানে পাক আর্মিদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয় আমাদের। যুদ্ধে একজন সৈনিক মারা যান। এরপর আমরা ভারতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নেওয়ার জন্য ফিরে যায়।

তৈয়বুর রহমান বলেন, এরকম বড় অপারেশন করি অনেকগুলো। এরপর বড়ো অপারেশনে অংশগ্রহণ করি ১৭ নভেম্বর তারিখে। ওই সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাক আর্মিদের ক্যাম্প ‘ইসলামপুর ক্যাম্প’ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফরিদপুর ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিই। ওখান থেকে আমরা সুবেদার ইসমাইলের নেতৃত্বে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ইসলামপুর ক্যাম্প আক্রমণের যুদ্ধে আমাদের ৮ জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। আমি আগে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও পরে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৭ নভেম্বরের পর থেকে বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

তৈয়বুর রহমান বলেন, ১২ ডিসেম্বর বড় ধরনের যুদ্ধ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। ওই যুদ্ধে অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। আমি যে তাঁবুতে ছিলাম, সেই তাঁবুর পাশে পাক আর্মিদের ছোঁড়া মর্টার শেল এসে বিস্ফোরণ ঘটে। আমি দ্রুত ছিটকে পড়ি। যুদ্ধটা করার জন্য রাজরামপুর হাইস্কুলে আমরা ডিফেন্স নিই। এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনী আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। যুদ্ধে আমরা পিছু হটি। পরে ওখান থেকে গোদাগাড়ীর হরিপুর নামক স্থানে এসে আমরা ডিফেন্স নিই। পরের দিন সকালে ফায়ার করতে করতে পাক আর্মিরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পিছু হটতে থাকে। এসে রাজশাহীতে পৌঁছে। আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত ঘোষণা করি। ওখান থেকে ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজশাহী বেতারে আসি। এসে ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী মুক্ত ঘোষণা করি।

/এফএইচএম/