নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার রায় হবে আগামী ১৬ জানুয়ারি। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যেসব আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনজন হলেন র্যাবের চাকরিচ্যুত ও অবসরে পাঠানো সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ,মেজর আরিফ হোসেন ও নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা। এ তিনজনই সাত খুনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন।
২০১৪ সালের ৫ জুন রানার জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
আদালতে রানার দেওয়া জবানবন্দির উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো:
২০১৪ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ নিজেই মেজর আরিফকে নজরুলের একটি প্রোফাইল দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে এবং আমাকে আরিফকে সহায়তার নির্দেশ দেন। নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আনুমানিক ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে আমি কোম্পানি কমান্ডারের গাড়িতে মেজর আরিফের কাছে পৌঁছাই এবং গাড়ি ছেড়ে দেই। এরপর মেজর আরিফের নীল কালারের মাইক্রোবাসে উঠে দেখি মেজর আরিফ, নূর হোসেন, নিজস্ব সোর্স, নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে নজরুলের বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন।
ওই সময় মেজর আরিফ আমাকে বলেন, স্যার, নজরুল একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার সঙ্গে সব সময় ৪/৫টি আর্মস থাকে। আমরা সিভিল ড্রেসে তাকে গ্রেফতার করতে গেলে সে আমাদেরকে নূর হোসেনের লোক ভেবে গুলি করে বসতে পারে।
মেজর আরিফ আরও বলেন, স্যার, আপনার ইউনিফর্মধারী পেট্রোল টিমকে দিয়ে ফাঁকা জায়গায় নজরুলকে আটকাতে হবে। যেহেতু মেজর আরিফ অপারেশন কমান্ডার সেহেতু আমি তার কথা মতো আমার ইউনিফর্মধারী পেট্রোল টিমকে নজরুলকে আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেই। আনুমানিক ১টার দিকে মেজর আরিফের কাছে ফোন আসে যে, নজরুল দুটি গাড়ি নিয়ে কোর্ট থেকে বের হচ্ছে। নজরুলের গাড়ি দুটি বের হওয়ার পর আমরা আমাদের মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে ওই গাড়ি দুটিকে ফলো করি এবং পেট্রোল টিমকে গাড়ি দুটির বর্ণনা দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পর সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা জায়গায় থামাতে বলি।
নজরুলের গাড়ি দুটির একটি সাদা কালারের, অন্যটি কালচে রংয়ের ছিল। আনুমানিক ১টা ২০ মিনিটের দিকে পেট্রোল টিম নজরুলের গাড়ি দুটিকে সিটি করপোরেশনের গেটের মুখে থামায়। তখন আমাদের দুটি মাইক্রোবাসে থাকা সিভিল টিম নজরুলের গাড়ি দুটিতে থাকা সবাইকে গ্রেফতার করে আমাদের মাইক্রোবাস দুটিতে তোলে। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে ঘটনাস্থলে পেট্রোল টিমের সঙ্গে থেকে যাই এবং মেজর আরিফ ধৃত লোকদেরসহ মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে চিটাগাং রোডের দিকে চলে যায়।
আমি সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আদমজীনগরে ব্যাটালিয়ন সদরে ফিরে অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করি এবং তাকে জানাই যে, নজরুলসহ ৫/৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নজরুলের দুটি গাড়ির একটিকে সরানো হয়েছে অন্যটি ঘটনাস্থলে পড়ে আছে। তখন সিও স্যার বলেন যে,ওই গাড়িটিও সরানোর ব্যবস্থা করো। সিও-এর নির্দেশনা অনুযায়ী আমি ড্রাইভার কনস্টেবল মিজানকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পরিত্যক্ত কালচে রংয়ের গাড়িটি নিয়ে আনুমানিক ৩টা ৪৫ মিনিটে গুলশান নিকেতনে রেখে আসি।
গাড়িটি রেখে আসার সময় ভেতরে অ্যাডভোকেটের ভিজিটিং কার্ড দেখতে পাই। তখন বুঝতে পারি যে, এই গাড়ির লোকটি একজন অ্যাডভোকেট। সিওকে জানাই যে, নজরুল সহ ধৃতদের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট রয়েছেন। আনুমানিক ৫টা ১০ মিনিটের দিকে মেজর আরিফ আমাকে ফোন করলে জিজ্ঞাস করি, মোট কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তখন সে বলে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আমি বলি যে, ওই সাত জনের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট আছে। তুমি অপারেশন কমান্ডার তাই তার সম্পর্কে বুঝে শুনে সিও স্যারকে সাজেশন দিও।
আনুমানিক ৫টা ২৫ মিনিটের সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে যে, আপনার ক্যাম্পে থাকা ট্রলারটি রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর আমি ট্রলারটি পাঠানোর বিষয়ে সিও স্যারের অনুমতি নিয়ে লিডিং সিম্যান সামাদকে, মেজর আরিফের মোবাইল নম্বর ০১৭৮২-৪৬০০৬৪ দিয়ে তার সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রলার নিয়ে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে থাকতে বলি। রাত আনুমানিক ১০টা ৪০ মিনিটের সময় আমি বাসায় চলে যাই।
অনুমান রাত ১টার দিকে মেজর আরিফের অধীনে থাকা মাইক্রোবাসসহ সিভিল টিমটি ক্যাম্পে পৌঁছানোর বিষয়ে রিপোর্ট করে। রাত ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে এডিজি (ওপস) কর্নেল জিয়া আমাকে ফোন করে বলেন, আরিফ ...। আমি বলি স্যার, আমি আরিফ না, রানা, আরিফের নম্বর শেষে ডবল ফাইভ। এরপর স্যার ফোন রেখে দেন।
পরের দিন ২৮ এপ্রিল আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার সময় মেজর আরিফ বলে, স্যার কর্নেল জিয়া গতকাল রাত তিনটায় আমাকে ডেকেছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন যে, নজরুলদের কেন মারছো? কীভাবে মারছো?
ওই সময় মেজর আরিফ আরও বলেন, আমি রাত সাড়ে ১২টার সময় এক্সিকিউশন করেছি, ইনজেকশন পুশ করে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শ্বাসরোধ করে গাড়ির ভেতরে। আর কর্নেল জিয়া স্যার আমাকে ফোন করেছেন রাত দুটায়। উনি আমাকে সাড়ে ১১টা কিংবা ১২টায় কল দিলেতো আর এই জিনিসটা হতো না।
/বিটি/এপিএইচ/
আরও পড়ুন: না. গঞ্জে ৭ খুন মামলার রায় ১৬ জানুয়ারি: জবানবন্দিতে যা বলেছেন আসামি আরিফ