সুন্দরবনের বনজীবীদের কষ্টকথা

হেদায়েৎ হোসেনসুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোর বনজীবীদের কষ্টের দিন যেন শেষই হচ্ছে না। সুদিন ফেরাতে পরিবারের সবাই সংগ্রাম করছেন। কিন্তু তিন বেলার আহারই জুটছে না। ফলে বনজীবীরা গ্রাম ছেড়ে ছুটছেন বিভিন্ন শহরে। অস্তিত্ব হারাতে বসেছে চিরায়ত একটি পেশা।
সুন্দরবনে গোলপাতা কাটা, কাঁকড়া ধরা আর মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করেন পুরুষরা। শিশুরাও তাদের সঙ্গে কাজে যোগ দেয়। আর নারীরা ব্যস্ত থাকেন চিংড়ি পোনা সংগ্রহে। সংসারের রান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করার পর তাদের চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে নদীর পাড়ে অধিকাংশ সময় থাকতে হয়। মেয়েশিশুরা থাকে মায়ের সহযোগী হয়ে। আবার পেটের টানে প্রয়োজনে নারীরা কখনও কখনও নৌকায় চেপে সুন্দরবনেও যান মাছ ধরতে।
খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার অন্যতম প্রধান নদী শাকবাড়িয়ার তীরে সুন্দরবন সংলগ্ন ১৫টি গ্রামে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গ্রামগুলো হচ্ছে— মঠবাড়ি, কাশিয়াবাদ, কয়রা ৪ নম্বর, ৫ নম্বর, ৬ নম্বর, পাথরখালী, মাটিকাটা, গাববুনিয়া, শাকবাড়িয়া, হরিহরনগর, গাতিঘেরি, বীনাপানি, জোড়শিং, আংটিহারা ও গোলখালী।
এই ১৫টি গ্রামের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এখনও বনের সম্পদের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। বনজীবীদের কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে— মাছ ও কাঁকড়া ধরা, গোলপাতা কাটা ও মধু সংগ্রহ করা। বনের ভেতর ও আশপাশের নদী-খালে এরা চিংড়ি পোনাও ধরে থাকেন। জীবিকা নির্বাহে এটাও তাদের অন্যতম কাজ।
তবে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আর প্রাকৃতিক নানা কারণে বনজীবীরা এখন আর বনে গিয়ে সম্পদ সংগ্রহ করতে পারছেন না। ফলে এখানে বসবাসরত বনজীবীদের বেঁচে থাকাই কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ বাপ-দাদার আমল থেকেই সুন্দরবনের সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। কিন্তু এখন তাদের বছরের একটা বড় সময়ই কর্মহীন থাকতে হচ্ছে। এখন অনেকেই বনের কাজ ছেড়ে মাটিকাটা, নদীভাঙন রোধে ব্লক বানানো, বালুর বস্তা নদীতে ফেলাসহ নানা কাজ করছে। তবে প্রাপ্ত পারিশ্রমিকে তারা সন্তুষ্ট নন।
শাকবাড়িয়া গ্রামের কৃষ্ণপদ ম-ল জানান, বনে যেতে না পারার কারণে এখন বাড়িতেই সময় কাটে। আশপাশের চিংড়ি ঘেরে কিছুটা সময় দিলেও প্রত্যাশিত অর্থ পাওয়া যায় না। পেটের টানে ঝুঁকি নিয়ে চুরি করে হলেও বনে যেতে হয়। কিন্তু ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। ফলে কাজে অগ্রগতি হয় না। সংসারের টানাপড়েনও যায় না।
সুন্দরবনকাশিয়াবাদ ও মঠবাড়ি গ্রামের অনেক মানুষ নতুন বাঁধের ভেতর ও বাইরে আশ্রয় নিয়েছেন। বাঁধের দু’ধারে রয়েছে সারি সারি ছাউনিঘর। এসব মানুষের রয়েছে পানির কষ্ট। খাবার সংকট সহ্য করে তারা বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন বটে কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পান না তারা। বনজীবীদের ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যায় না। সংসারের টানাপড়েন ঘোচাতে তারাও বাবা-মার সঙ্গে নদী বা বনেই ব্যস্ত থাকে।
শাকবাড়িয়া গ্রামের চপল পাইন বলেন, ‘বনে যাওয়া যায় না। এছাড়া বিকল্প কাজেরও কোনও নিশ্চয়তা নেই। ঘের, মাটি কাটাসহ কিছু কাজ পাওয়া গেলেও মজুরি সামান্য। এসব কাজে দিনভর কঠোর পরিশ্রম করেও দুই শ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এ অবস্থার কারণে মাঝে মধ্যে আট বছরের ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়েই বনে যেতে হয়। বনদস্যুদের আতঙ্ক, বাঘের ভয় আর বন বিভাগের কঠোর তৎপরতায় এখন বনে যাওয়া কঠিন। পাস পারমিট নিয়ে বনে গেলেও টাকা লাগে।’
স্থানীয় বাসিন্দা খলিল ঢালী জানান, তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করছেন। ১৮ চৈত্র থেকে মধু সংগ্রহের পারমিট দেওয়া হয়। আটজনের একটি দল নিয়ে তিনি এক মাসের জন্য মধু সংগ্রহে যান। এক মাস পর ১৫ দিনের বন্ধ রেখে আবার যেতে হয়। এভাবে তিন মাস চলে মধু সংগ্রহ। কিন্তু পারমিট নিয়ে মধু আহরণে গেলেও বন প্রহরীদের টাকা দিতে হয়। আর দস্যুদের বিচ্ছিন্ন তৎপরতার কবলে পড়লে তো রক্ষা নেই।
কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের ডেপুটি রেঞ্জার মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘সুন্দরবনে এখন কাঠ চুরির কোনও সুযোগ নেই। বন প্রহরীরা খুবই সতর্ক। তাই পারমিট ছাড়া কোনও লোকই এখন বনে যেতে পারে না। পাস পারমিট নিয়ে বনে যাওয়া বনজীবীরা নির্বিঘেœই অনুমোদিত কাজ করতে পারে। বৈধভাবে বনে গিয়ে অবৈধ কাজ করতে গেলে সে বাধার মুখে পড়ে। বন প্রহরীরা প্রতিটি এলাকায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে।’
র‌্যাব-৮-এর মেজর আদনান কবীর বলেন, ‘গত এক বছরে ১০টি বাহিনী প্রধানসহ ১০৭ বনদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। এসব দস্যু ২৪৭টি অস্ত্র ও ১৪ হাজার রাউন্ড গুলি জমা দিয়েছে। র‌্যাব এ পর্যন্ত অভিযানে ৮৯০টি অস্ত্র, ২৩ হাজার ৩৫৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার এবং ৩০৯ দস্যুকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে এখন সুন্দরবনে দস্যুদের কোনও তৎপরতা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে নতুন কিছু বনদস্যু মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলেও র‌্যাবের সতর্কতার কারণে তারা টিকছে না।’