পানি কমছে, বাড়ছে দুর্ভোগ

বন্যায় ভেসে যাওয়া জয়পুরহাট অঞ্চল, মঙ্গলবার বিকালে বিমান থেকে তোলা (ছবি- নাসিমা খন্দকার)

দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করায় বেশ কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে প্লাবিত অঞ্চলগুলোর মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। ঘরবাড়ির চারপাশে এখনও পানি থাকায় কার্যত পানিবন্দি হয়ে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্গত মানুষদের অভিযোগ, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গবাদি পশু-পাখি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন তারা।  পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও মিলছে না চিকিৎসাসেবা। এদিকে, পানি কমলেও বন্যাকবলিত বেশিরভাগ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) পর্যন্ত বন্যায় ৩২ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। সোমবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল ২৪। মঙ্গলবার দিনাজপুরে ৭ জন ও ঠাকুরগাঁওয়ে এক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়।

বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে গাইবান্ধা, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতি এখনও অবনতির দিকে।

বন্যায় ভেসে যাওয়া জয়পুরহাট অঞ্চল, মঙ্গলবার বিকালে বিমান থেকে তোলা (ছবি- নাসিমা খন্দকার)

আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজান ও রত্নাইসহ সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাঁচটি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষজন চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন। প্রায় চার শতাধিক গৃহহীন পরিবার খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। জেলার ৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় নয় হাজার মানুষ অবস্থান নিয়েছেন। দুর্গত মানুষরা জানান, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না তারা। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েও পাচ্ছেন না চিকিৎসাসেবা।

নীলফামারী প্রতিনিধির পাঠানো খবরে বলা হয়েছে, নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তিস্তার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি ডিমলা ও জলঢাকার দুই লক্ষাধিক মানুষের। হাতে কাজ না থাকায় আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে তাদের। বিশুদ্ধ পানির অভাবে নানান রোগ দেখা দিয়েছে। নীলফামারী ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চারটি গ্রাম একেবারে পানিতে তলিয়ে আছে। ওই চার গ্রামের দশ হাজার মানুষের ভোগান্তি এখন আরও বেড়েছে।

দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে (ছবি- প্রতিনিধি)

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। তবে পানি কমলেও রান্নাবান্না ও গবাদি পশু নিয়ে মানুষ পড়েছেন বিপাকে। তার ওপর ত্রাণ সহায়তা মিলছে না বলে অভিযোগ বানবাসিদের। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রের আশা, বুধবারের মধ্যেই শহর ও গ্রামাঞ্চলের পানি সম্পূর্ণ নিচে নেমে যাবে। এ জেলায় ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ১৫ জন মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২২ জনে। দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম  ও জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বরত ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোকলেছুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দুর্গত মানুষরা ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে। এদিকে, তিন দিন আগে নিখোঁজ হওয়া রিয়াদ (২০) নামের এক কলেজ ছাত্রের লাশ মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার করা হয়। টাঙ্গন নদীতে ভেসে ওঠার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লাশটি উদ্ধার করেন। এছাড়া এখনও তিন শিশু নিখোঁজ রয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা আছে। আরও চাওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।’

সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে (ছবি- প্রতিনিধি)

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সোমবার থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, ‘গতকাল সোমবার থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি বহাল থাকলে পানি দ্রুত নেমে যাবে।’ তবে পানি কমতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি এ জেলার বন্যাকবলিত মানুষের।

একইভাবে পানি কমার তথ্য জানিয়েছেন বগুড়া, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, পঞ্চগড়, রংপুর, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিনিধি। অপরদিকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কথা জানিয়েছেন গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরের প্রতিনিধিরা।

নীলফামারীর বন্যা কবলিত একটি এলাকা (ছবি- প্রতিনিধি)

 আমাদের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান,  ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে সদর উপজেলা, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যে চার উপজেলার ২৬ ইউনিয়নের ৩০ হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে আমন চারাসহ বিভিন্ন জাতের ফসলি জমি। পানিতে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। গত ৫ দিন ধরে পানিবন্দি ও বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। এদিকে, পলাশবাড়ী উপজেলার করতোয়া নদীর পানির চাপে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দু’টি জায়গা ধসে গেছে। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ একটি কাঁচা রাস্তা ভেঙে গেছে। পানিতে ৪০ গ্রামের ঘরবাড়ি, আমন ধান, পুকুর, বীজতলা, শাক-সবজি, পানের বরজ ও আখ ক্ষেতসহ বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে তিন প্লাটুন সেনাবাহিনী কাজ করছে। সোমবার বিকালে রংপুর থেকে আসা সেনাবাহিনীর কারিগরি দল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা মেরামতের কাজ শুরু করেছে।

গাইবান্ধার ডুবে যাওয়া এক এলাকা (ছবি- প্রতিনিধি)

কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতিও অবনতির দিকে বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি। তার ওপর খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার না থাকায় নাজেহাল অবস্থা এ জেলার বন্যাদুর্গত মানুষের।

রাস্তায় রাত কাটছে বানভাসি মানুষের (ছবি- প্রতিনিধি)

নওগাঁ প্রতিনিধির পাঠানো খবরে জানা যায়, জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রাণীনগর উপজেলার বেতগাড়ী, ঘোষগ্রাম ও কৃষ্ণপুর এলাকায় নতুন করে আরও ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে আত্রাই উপজেলা ও নাটোর জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মান্দায় দুইটি, আত্রাইয়ে একটি ও রাণীনগরে ছোট যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাঁচটি স্থানে ভেঙে গেছে। বাঁধ ভেঙে গিয়ে ঘরবাড়ি ও ফসল ডুবে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অবহেলাকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা।

গবাদি পশুর সঙ্গে একই চালার নিচে দুর্গত মানুষ (ছবি- প্রতিনিধি)

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, উজানের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। যমুনার পানি মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) সকাল ৬টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলা পয়েন্টে যমুনার পানি ২৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

বন্যায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রুটের রেললাইনে পানি (ছবি- প্রতিনিধি)

জামালপুর প্রতিনিধির পাঠানো খবরে জানানো হয়, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি প্রবাহ ১৯৮৮ সালের বন্যার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) সকালে এ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ৮৮-এর বন্যায় এই পয়েন্টে পানি ছিল বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপরে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে নতুন করে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে জামালপুর সদর ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। মাদারগঞ্জের চাঁদপুর-নাংলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দেড়শ মিটার ভেঙে এই উপজেলার ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সবমিলিয়ে জেলার ৭টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন।

/এনআই/এমএ/এএইচ/