২৯ বছরেও ধরা পড়েনি মুনির-তপন-জুয়েলের হত্যাকারী!

মুনির-ই কিবরিয়া চৌধুরী, তপন জ্যোতি দে ও এনামুল হক জুয়েল (ছবি- প্রতিনিধি)

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর। ২৯ বছর আগের এই দিনে হত্যা করা হয়েছিল সিলেটের ওই সময়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও জাসদ ছাত্রলীগের তিন কর্মী মুনির ই কিবরিয়া, তপন জ্যোতি দেব এবং এনামুল হক জুয়েলকে। এই তিন ছাত্রনেতাকে হত্যার মাধ্যমেই সিলেটের ছাত্র রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলার আসামি ছাত্রশিবিরের নেতাদের সবাই বেকসুর খালাস পান। তাই আজ অবধি মুনির-তপন-জুয়েলের হত্যাকারীরা চিহ্নিত হয়নি। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন, ৪০-৫০ বছর আগের অনেক মামলারও বিচার হচ্ছে। তাই ২৯ বছর আগের মুনির-তপন-জুয়েল হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হোক।

জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও জাসদ সিলেট জেলা শাখার সভাপতি লোকমান আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৮৮ সালে জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হয়ে আন্দোলন করতে গিয়েই জামায়াত আর শিবিরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুনির-তপন-জুয়েল। মামলায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকাসহ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য না দেওয়া ও পালিয়ে যাওয়ার কারণেই মামলার আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। মুনির-তপন-জুয়েলের হত্যাকারীরাও তাই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

জানা গেছে, আশির দশকে সিলেটে ছাত্রশিবির রাজনীতি শুরু করলে তারা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর বাধার মুখে পড়ে। ওই সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় ছাত্রদল ও জাতীয় ছাত্রলীগ। এই পরিষদের তৎপরতার কারণেই সিলেটের কোনও ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি ছাত্রশিবির। এসময় তারা সিলেট শহরতলির বরইকান্দি এলাকায় সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে নিজেদের সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে।

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে সিলেটের ছাত্র রাজনীতি। তবে ২০ সেপ্টেম্বরের ওই নির্বাচনে ১৫ পদের সবগুলোতে জয়ী হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এরপরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রশিবির। ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে শিবিরকর্মীরা এমসি কলেজ ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। এসময় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পেরে কলেজের আশপাশে অবস্থান নেন। এ অবস্থায় আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আসা একদল সশস্ত্র শিবিরকর্মী নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় জড়ো হওয়া জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। তাতে গুরুতর আহত হন মুনির ও তপন। পরে হাসপাতালে তাদের মৃত্যু হয়। ওইদিনই শিবিরের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে আম্বরখানায় স্কুলছাত্র এনামুল হক জুয়েলকে ধাওয়া করে। জুয়েল দৌড়ে একটি মার্কেটের ছাদে উঠে গেলেও তার পিছু ছাড়েনি ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা। উপায়ন্তর না দেখে জুয়েল মার্কেটের ছাদ থেকে পাশের একটি ছাদে লাফ দিতে গেলে নিচে পড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

মুনির, তপন ও জুয়েল হত্যাকাণ্ডের পর প্রয়াত জাসদ নেতা ছদরউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রশিবিরের নেতা জিয়াউদ্দিন নাদের, সায়েফ আহমদ, সোহেল আহমদ চৌধুরী, জিয়াউল ইসলাম, আবদুল করিম জলিলসহ অজ্ঞাত বেশ কয়েকজনের নামে মামলা করেন। মুনির ও তপন হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শামীম সিদ্দিকী, সাংবাদিক কামকামুর রাজ্জাক রুনু ও বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। মামলা চলাকালীন তারা কেউই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে এসে সাক্ষ্য দেননি।

অভিযোগ আছে, এই মামলায় কামকামুর রাজ্জাক রুনুর সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণ হলো মামলার অন্যতম আসামী সুহেল আহমদ চৌধুরী তার আত্মীয় ছিল। মামলার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন বিষ্ণুপদ চক্রবর্ত্তী মামলা চলাকালীন সিলেট ছেড়ে চলে যান এবং মামলা শেষ হওয়ার আগে আর সিলেটে আসেননি। সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় মামলার আসামিরা সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ২৯ বছরেও আর তাই ‍মুনির-তপন-জুয়েলের হত্যাকারীরা থেকে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা প্রশ্ন তোলেন, মুনির-তপন-জুয়েলকে কি কেউ হত্যা করেনি?

আশির দশকের ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুনির-তপন-জুয়েল ছিল সিলেটের প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক। তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে সিলেটে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি শুরু হয়। আলোচিত এ হত্যা মামলার সাক্ষীরা বিভিন্ন কারণে প্রভাবিত হওয়ার কারণেই ন্যায়বিচার পায়নি মুনির,তপন ও জুয়েলের পরিবার।’

আশির দশকের তৎকালীন সিলেট জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সদস্য ও বর্তমান মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি জিয়াউল গণি আরেফিন বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ৪০-৪৫ বছর আগের মামলাগুলোরও বিচার হচ্ছে। যদি এমনভাবে মুনির-তপন- জুয়েল হত্যার বিচার শেষ করা হয়, তাহলে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। বিচারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাও আরও বাড়বে। আমরা চাই, ২৯ বছর পরে হলেও বিচার হোক মুনির-তপন-জুয়েল হত্যাকাণ্ডের।’