দখল-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহের নদীগুলো

নদীর পাড় ঘেঁষে উঠছে ঘরবাড়িদখল-দূষণ ও খননের অভাবে ঝিনাইদহের নদ-নদীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। বেশির ভাগ নদীই পরিণত হয়েছে মরা খালে। এ সুযোগে দখলে মেতে উঠেছে প্রভাবশালীরা। পাড়ে উঠছে ঘরবাড়ি, হচ্ছে চাষাবাদ। পাড় দখল মুক্ত করতে বা খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কোনও পদক্ষেণ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এক সময় ঝিনাইদহের নবগঙ্গা নদীতে প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যেত। সেই সূত্র ধরেই জেলার নামকরণ করা হয় ঝিনাইদহ। জেলাটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ১২টি নদী। প্রমত্তা এসব নদীতে পাওয়া যেত নানা জাতের মাছ; চলাচল করতো বড় বড় নৌকা। যার সূত্র ধরে নদী পাড়ে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

নদীর পাড়ে স্থাপনাএখন চিত্র একেবারেই উল্টো। নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। করা হচ্ছে ধান, সরিষা, কালাই, মসুর, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। চরানো হচ্ছে গবাদি পশু। নদীতে কমেছে মিঠা পানির মাছ। বর্ষা মৌসুমে নদীতে কিছুটা পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হওয়া যায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুমার নদের শৈলকুপা অংশের জিন্না আলম ডিগ্রি কলেজ এলাকা, বারই পাড়া এলাকা, কবিরপুর, বিজুলিয়া, হাট ফাজিলপুর অংশসহ বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে বড় বড় চর।

শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে চাষাবাদঅন্যদিকে, মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে নদী দখল। নবগঙ্গা নদীর ধোপাঘাটা ব্রিজ, চাকলাপাড়া, মডার্ন এলাকা, কুমার নদের জিন্না আলম ডিগ্রি কলেজ এলাকা, কবিরপুর, শৈলকুপা নতুন ব্রিজ, চিত্রা নদীর নিমতলা এলাকা, পুরাতন বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তীর দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নদীতীর থেকে যে যার মতো করে কেটে নিচ্ছে মাটি। ড্রেনের ময়লা পানি গিয়ে পড়ছে নদীতে। এসব কারণে একদিকে যেমন কমছে নদীর প্রশস্ততা, সেইসঙ্গে মাছসহ জলজ প্রাণী ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে।

জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ নিয়ে কথা হয় শৈলকুপার কবিরপুর এলাকার চাষী সাত্তার মন্ডলের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ২৫ বছরের মতো নদীতীরে চর জেগে উঠেছে। সেই থেকেই তিনি এই চরে ফসল চাষ করছেন। ফলনও হচ্ছে ভালো। শুধু বর্ষার সময় অল্প কিছুদিন পানি থাকে। অন্যান্য সময় পানি থাকে না। শুকনো মৌসুমে নদী একেবারেই শুকিয়ে যায়।

নদী পরিণত হয়েছে খালে, পাড়ে উঠছে ঘরবাড়িকালীগঞ্জের অসিত কুমার জানান, প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চিত্রা নদীতে মাছ ধরেন তিনি। আগে যেখানে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ কেজি মাছ পাওয়া যেত, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কেজিতে। আবার কখনও তাও পাওয়া যায় না।

পরিবেশবিদ মাসুদ আহম্মেদ সঞ্জু জানান, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে জালের মত নদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু আজ সেটি স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ও মানুষ্য সৃষ্ট কারণে নদীগুলো আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। এতে এক সময় পানির সংকট সৃষ্টি হবে। এছাড়া, নদীতে বিভিন্ন জলজ প্রাণী বসবাস করে যারা পরিবেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদী ভরাট হয়ে যাওয়া ও নানাভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে এসব প্রাণী। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এক সময় পরিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়বে। তাই বিশেষজ্ঞ ও সর্বস্তরের মানুষের দাবি নদীগুলো যেন অতি দ্রুত খনন ও দখল মুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহমানতা ফিরিয়ে আনা হয়।

নদীর পাড় ঘেঁষে উঠছে বাড়িএ ব্যাপারে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন বলেন নদী খননের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বদ্ধপরিকর। নদীগুলো খনন করে তার স্বাভাবিক নাব্যতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমি সবাইকে নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছি, যাতে নদীগুলো খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।

জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে, ঝিনাইদহের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো হলো, নবগঙ্গা, চিত্রা, কুমার, বেগবতি, গড়াই, ইছামতি, ডাকুয়া, কপোতাক্ষ, কালীগঙ্গা, কোদলা, ফটকী ও  বুড়ী। এগুলো মোট আয়তন ১ হাজার ৬৪১ দশমিক ৭৫ হেক্টর।