কেন বারবার পাথর কোয়ারিতে মৃত্যু?

 


সিলেটের পাথর কোয়ারি‘যত বেশি ঝুঁকি, তত বেশি টাকা’—এমন একটি কথা প্রচলিত আছে কোয়ারিতে। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তাই কোয়ারিতে পাথর তোলা বন্ধ হয় না। আর পাড় ধসে প্রাণহানিও থামছে না।
কোয়ারির পাড় ধসের ঘটনায় ২০১৭ সাল থেকে এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিলেটে নিহত হয়েছেন ৪৪ শ্রমিক। জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশের যথাযথ তদারকি না থাকায় বারবার পাথর কোয়ারিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে পরিবেশবাদীদের দাবি। তারা বলছেন, শ্রমিকদের গরিবির সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পাথর তোলায় জড়িত প্রভাবশালীরা তাদের ঠেলে দিচ্ছে কোয়ারিতে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইঘাট ও জাফলং এলাকায় পাথর কোয়ারিতে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে। অতিরিক্ত টাকার লোভ দেখিয়ে পাথর কোয়ারিতে তাদের নামানো হয়। শ্রমিকদের লোভ দেখানো হয়, কোয়ারির যত গভীরে যাবে, মজুরিও তত বেশি পাবে। টাকার লোভে কোয়ারির গর্তে নেমে পাহাড় খোঁড়ে শ্রমিকরা। পাহাড় কেটে পাথর নিয়ে উপরে আসার সময় পাড় ধসে তারা প্রাণ হারান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জানিয়েছে, পাথর তোলার সময় শাহ আরপিন টিলা, জাফলং, বিছানাকান্দি, লোভাছড়া ও বাংলাটিলাতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৭ জন শ্রমিক নিহত হন। এছাড়া ২৫ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জে পাঁচজন, জৈন্তাপুরের শ্রীপুরে একজন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি কানাইঘাটের লোভাছড়ায় গর্ত ধসে ফরমান উল্লাহ নামের আরেক শ্রমিক নিহত হন। অর্থাৎ গত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ৪৪ জন শ্রমিক পাথর কোয়ারিতে নিহত হয়েছেন। এর আগেও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

সিলেটের পাথর কোয়ারিতে দুর্ঘটনার পর উদ্ধার তৎপরতাবেলা সূত্রে জানা গেছে, কোয়ারিতে যারা কাজ করে তাদের কোনও ধরনের অভিজ্ঞতা নেই। দীর্ঘদিন সিলেটের কোয়ারি থেকে পাথর তোলার কারণে কোয়ারি কিংবা টিলার ওপরে পাথরের স্তূপ নেই। এখানে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল আকারের গর্ত। একেকটি গর্ত ২০০-৩০০ ফুট গভীর।
কোম্পানীগঞ্জের পাথর কোয়ারিতে আহতদের বরাত দিয়ে সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামুসল আলম (গণমাধ্যম) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোয়ারি এলাকায় গর্ত কিংবা পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও শ্রমিকরা টাকার লোভে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে কালাইরাগ সীমান্ত সংলগ্ন কোয়ারিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচজন মারা যান। ঘটনার দিন রাতে গোপনে জেনারেটরের মাধ্যমে আলো জ্বালিয়ে কোয়ারিতে গর্ত করে পাথর তোলা হচ্ছিল। গভীর গর্ত করার পর একপর্যায়ে গর্তের পাড় ধসে চাপা পড়েন শ্রমিকরা।’
রাতের অন্ধকারে পাথর তোলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দিনের বেলা কোয়ারিগুলো মানুষশূন্য থাকে। পুলিশ কিংবা টাস্কফোর্সের অভিযানের ভয়ে রাতে কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাথর কোয়ারির সংখ্যা অনেক। সেজন্য খবর পেলেও সীমাবদ্ধতার কারণে পুলিশ রাতে অভিযান চালাতে পারে না। আর পরদিন ঘটনাস্থলে পুলিশ যাওয়ার পর কেউ মুখ খুলতে চায় না। এসব বিষয়ে শ্রমিকদের আরও সচেতন হতে হবে।’
পাথর কোয়ারির কয়েকজন মালিক জানান, কোয়ারিতে বোমা মেশিন চালানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। কারণ, বোমা মেশিন চালাতে খরচ বেশি। শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে পাথর তুললে খরচ কম, লাভ বেশি হয়। যার কারণে কোয়ারিতে এই প্রথা চলছে। গর্তের গভীরে নেমে পাথর তোলার সময় পাড় ধসের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। দিনের বেলা পুলিশ ও টাস্কফোর্সের কারণে পাথর তোলা সম্ভব হয় না। এ কারণে রাতে জেনারেটরের আলোয় পাথর তোলা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম বলেন, ‘কোয়ারির গর্ত কিংবা পাহাড় কেটে গভীরে গিয়ে পাথর তোলার সময় পাড় ধসের ঘটনা ঘটে। কারণ, শ্রমিকরা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পাথর তোলেন। পুলিশ-প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে।’
পাথর কোয়ারিতে উদ্ধার তৎপরতাতিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় কোয়ারিগুলো পরিদর্শন করে জেনেছি, সিলেটের হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে শ্রমিকরা দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। এমনকি মালিক পক্ষ থেকে তাদের আবাসনেরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। কোয়ারিতে একটি কথার প্রচলন রয়েছে, ‘যত বেশি ঝুঁকি তত বেশি টাকা।’
বেলা’র সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বলেন, ‘দায়সারা অভিযান পরিচালনা করে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর। মামলা হচ্ছে, কিন্তু মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞাত নয় অধিদফতর। অভিযানের খবর আগে থেকেই পেয়ে যায় পাথরখেকোরা। এ থেকে বোঝা যায় প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সখ্য আছে। কোয়ারিগুলোতে শ্রমিক মারা গেলেও কোনও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না তারা।’

সিলেট পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক সালাহ উদ্দিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। তবু অভিযান থেমে নেই। এমনকি আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে থাকি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনার পর প্রশাসন সজাগ হলেও পরে তারা ঝিমিয়ে যায়। প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তিকে হাত করেই পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।’