‘দেখা হলো, জড়িয়ে ধরা হলো না’

জড়িয়ে ধরার প্রবল ইচ্ছেয় বাধা কাঁটাতারের বেড়া (ছবি- প্রতিনিধি)

‘ছেলে ও ছেলের বউকে আগেই দেখেছি। কিন্তু নাতিকে দেখলাম এবারই প্রথম। কত বড় হয়ে গেছে সে। অনেক গল্প করলাম। কত দিন পর দেখা, কিন্তু বুকে জড়িয়ে ধরা হলো না।’

ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কলকান্দা গ্রামের জরিনা বেগম। তার পর কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে নাতিকে উদ্দেশ করে যতটা পারেন জোরে বলেন, ‘আরও কিছুক্ষণ থাকো না, দাদুভাই।’ ওপারে (ভারতে) দাঁড়ানো নাতি আনোয়ারকে আরও খানিক্ষণ ‘কাছে পেতে’ তার এই আকুলতা।

অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে যতক্ষণ পারা যায় ভেজা চোখে ২০ বছর বয়সী নাতির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন জরিনা বেগম। অস্ফুট কণ্ঠে মাঝে মধ্যে যা বললেন, তার বেশিরভাগটাই হারিয়ে গেল অনেক মানুষের কলরবে।

বাংলাদেশ-ভারতের ভৌগোলিক সীমারেখা আলাদা করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। কিন্তু সে কাঁটাতার আলাদা করতে পারেনি দুই দেশের মানুষের ভালোবাসার টান। সুযোগ পেলে সেই টানেই তারা ছুটে আসেন সীমান্তে বেড়ার কাছে। আজ রবিবার (১৫ এপ্রিল) তেমনই এক সুযোগ এসেছিল দুই দেশের মানুষের জন্য। এ দিন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের নাগর নদের পারে বেতনা সীমান্তে বসেছিল বাংলাদেশ-ভারতের মানুষের মিলনমেলা। পয়লা বৈশাখ (ভারতে ছিল রবিবার) উপলক্ষে এই অনানুষ্ঠানিক মিলনমেলার আয়োজন করা হয়।

রবিবার সকালে ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার হরিপুর বিওপি থেকে জগদল বিওপি পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার পাশে এসে সমবেত হন জরিনা বেগমের মতো দুই বাংলার হাজারও মানুষ। লক্ষ্য, স্বজনদের সঙ্গে ক্ষণিকের সাক্ষাতের সুযোগ নেওয়া।

কাঁটাতার বুকে নিয়ে হৃদয়ে মিললো হৃদয় (ছবি- প্রতিনিধি)জরিনা বেগম জানান, একাত্তরে তার স্বামী ও সন্তান ভারতে চলে যান, বাংলাদেশে থেকে যান তিনি (জরিনা) ও তার মেয়ে। গরিব হওয়ার কারণে পাসপোর্ট-ভিসা করতে পারেনি। তাই সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন আজকের দিনটার জন্য।

কেবল জরিনা বেগম নয়; আরও অনেকে জানান, প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে বিজিবি ও বিএসএফের সম্মতিতে দুই দেশের বাঙালিরা পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া সাক্ষাতের সুযোগ পান। কাঁটাতারের বেড়া তাদের আলাদা করে রাখলেও আবেগ পৌঁছে যায় দেশকালের সীমানা ডিঙিয়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকে হরিপুর বিওপি থেকে জগদল বিওপি পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এলাকায় জড়ো হওয়া হাজারো মানুষ বিকাল ৪টা পর্যন্ত ছিলেন। অনেকে জানান, দীর্ঘ দিন অপেক্ষার পর স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কাঁটাতারের গেট খুলে না দেওয়ায় স্বজনদের সঙ্গে কোলাকুলি ও বুক মিলাতে পারেনি কেউ। কেবল কাঁটাতারের এপারে ওপারে দাঁড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বিনিময় করেছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হাজেরা বেগম জানান, তার ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করেছেন। ২০ বছর আগে ভাই-বোনদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। ভাই-বোনদের দেখা পেয়ে তিনি খুব আনন্দিত।

স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে আসা লক্ষীরানী, শাহিনা, শাকির, শাহেদা, নারায়ণ চন্দ্র, গীতাদেবী সরেন মাড্ডীসহ আরও অনেকে জানান, প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিন একটি নির্দিষ্ট স্থানে কাঁটাতার তুলে দিয়ে দুই দেশের মানুষের মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করা সরকারের উচিত। কাঁটাতারের এপাশ-ওপাশে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি ও কাপড়-চোপড় বিনিময় করেন বলেও জানান তারা।

ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ হোসেন বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণভাবে মিলনমেলা হয়েছে। এ উপলক্ষে সীমান্তে বিজিবিসহ পুলিশবাহিনী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে।