চাষিদের অভিযোগ, প্রতিকারে কৃষি বিভাগের কোনও উদ্যোগ নেই। তবে কৃষিবিভাগ বলছে, রোগ প্রতিকারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা যখন আমচাষে অব্যাহত লোকসানের মুখে, তখন এ অঞ্চলের চাষিরা ঝুঁকে পড়েন পেয়ারা চাষে। গড়ে তোলেন নতুন নতুন পেয়ারা বাগান। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১ হাজার ৪০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে উন্নত জাতের বারি পেয়ারা-২ ও থাই পেয়ারা। ভালো ফলন ও সারা বছর ভালো দাম পাওয়ায় যখন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন পেয়ারা চাষিরা, তখনই ‘ফিউজেরিয়াম উইল্ট’ চাষিদের নতুন আতঙ্ক। সম্প্রতি এই রোগে সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন জেলার পেয়ারা চাষিরা। এ রোগে প্রথমে গাছের একটি ডাল ও পাতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে এক পর্যায়ে মারা যাচ্ছে পুরো গাছই। শুধু তাই নয়, এক গাছ আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পরেই আক্রান্ত হচ্ছে অন্যগাছ। আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বাগানেই। বাধ্য হয়ে পেয়ারা চাষিরা একে একে কেটে ফেলছেন পুরো বাগানের গাছই। আর জেলার প্রায় সব পেয়ারা বাগানেই এ রোগ দেখা দেওয়ায় এখন উজাড় হতে বসেছে ফলবান পেয়ারা বাগানগুলো।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের আমনুরা পাওয়েল এলাকার পেয়ারা চাষি সামিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ৮ বিঘা পেয়ারা বাগানে এ রোগে ইতোমধ্যেই ১২’শ গাছের মধ্যে ৯’শ গাছ মারা গেছে। একটি গাছে ফলন আসতে দুই বছর লাগে। এরপর দুই বছরের মাথায় মরে যাচ্ছে। এতে করে চাষিদের লাভ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়ছে। আর ফলবান এসব গাছ মরে যাওয়ায় আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়ছেন কেউ কেউ।’
ওই এলাকার আরও কয়েকটি পেয়ারা বাগান ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা এলাকার পেয়ারা চাষি আব্দুল মান্নান জানান, ‘পেয়ারা চাষের আগে জাত আম চাষ করে অব্যাহত লোকসানের মুখে ছিলাম। অনেক আশা নিয়ে থাই পেয়ারা চাষ শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে বেশ ভালোই লাভ হচ্ছিলো। ভালো ফলন ও সারা বছর দাম পাওয়ায় যখন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করি তখনই এই রোগে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। জমি লিজ নিয়ে পেয়ারা চাষ করে এখন মূলধন উঠে আসা নিয়েই চিন্তিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুটি বাগানের মোট জমির পরিমাণ ২১ বিঘা। এর মধ্যে ১২ বিঘার বাগানের সব গাছ মরে গেছে। অপর বাগানের ৯শ’ গাছের মধ্যে এরই মধ্যে ৩’শ গাছ মারা গেছে। বাধ্য হচ্ছি গাছগুলো কেটে ফেলতে।’
সদর উপজেলার ঝিলিম ইউপি’র বালিকাপাড়া জামতাড়ার ফল চাষি মতিউর রহমানের পেয়ারাবাগানে গিয়ে দেখা গেছে, পাতা শুকিয়ে মরে গেছে বেশকিছু গাছ। তিনি গাছের নিচে মাটি সরিয়ে শিকড় বের করে দেখান, শিকড়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু গুটি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘আগে একটি পেয়ারা গাছ সাত-আট বছর ধরে ভালোই ফল দিত। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে এই রোগ দেখা দিয়েছে। এভাবে একের পর এক বাগানের গাছ মরে যাওয়ায় আমরা চাষিরা গাছ কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি। শুধু তিন-চার বছর বয়সী গাছই নয়, বাগানে নতুন করে লাগানো ছয়মাস বয়সী গাছগুলোও এ মড়ক থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।’
গোমস্তাপুর উপজেলার পেয়ারা চাষি সুবেদ আলী জানান, তার ১৫ বিঘার পেয়ারা বাগানে প্রায় ১২’শর মতো গাছ আছে। এরই মধ্যে প্রায় ৪শ’র মতো গাছ মারা গেছে। তিনি বলেন, ‘গাছগুলো মরে গেলে আমরা বাঁচবো কীভাবে? বাগানে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়বো। কৃষি বিভাগ এখন পর্যন্ত এ রোগের প্রতিকারে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি তাদের জানানো হলেও এখন পর্যন্ত বাগান পরিদর্শনেই আসেনি তারা। আমরা চাই কৃষি বিভাগ এ রোগের প্রতিকারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’
নাচোল উপজেলার পেয়ারা চাষি মনিরুল ইসলাম জানান, তার ৩০ বিঘার পেয়ারা বাগানে এ রোগে ইতোমধ্যে প্রায় ৪শ’ গাছ মারা গেছে। তিনি বলেন, ‘কী কারণে গাছগুলো মারা যাচ্ছে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এ রোগের নাম ও প্রতিকার আমাদের জানা নেই। কৃষি বিভাগকে জানিয়েও কোনও ফল পাচ্ছি না।’
তবে গবেষকরা বলছেন, পেয়ারার ‘ফিউজেরিয়াম উইল্ট’ বা ‘ঢলে পড়া রোগ’ একটি মাটি বাহিত ‘ফিউজেরিয়াম ছত্রাক’ আক্রান্ত রোগ। আর মাটি বাহিত বলে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টসাধ্য।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেসব পেযারা চাষ হচ্ছে তার একটি বড় অংশই হলো বারি পেয়ারা-২ ও থাইলান্ডের আমদানিকৃত বিভিন্ন জাতের থাই পেয়ারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই রোগের জীবানুর প্রতি এই জাতগুলো খুবই সংবেদনশীল এবং একে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও পেয়ারা চাষিদের প্রতি গবেষকদের পরামর্শ, বাগান ব্যবস্থাপনা (সঠিক দূরত্বে ৪/৪ মিটার দূরত্বে গাছ লাগানো) অনুসরণ, বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, ঢালাওভাবে পুরো বাগানে পানি ব্যবহার না করা এবং মাঝে মাঝে বাগানে ‘সয়েল ড্রেনঞ্চিং’ এর জন্য কার্বান্ডিজম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। এতে কিছুটা হলেও; এ রোগের থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, “যেহেতু এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে আমরা গবেষকরা চেষ্টা করছি, এই জাতগুলোকে কীভাবে অন্য জাত দ্বারা পুনঃস্থাপন করা যায়। এক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি স্থানীয় জাতগুলোর মধ্যে যদি কোনও জাতের ‘রুট স্টক’ পাওয়া যায় এবং সেটি উইল্ট প্রতিরোধী হয় তাহলে গ্রাফটিং পদ্ধতির (জোড় কলাম) মাধম্যে এই রোগটিকে কিছুটা হলেও দমন করা সম্ভব হবে।”
এদিকে, জেলায় পেয়ারা গাছের অকাল মোড়ক রোধে প্রতিকারের কথা জানালো জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মঞ্জুরুল হুদা জানান, “সারা বিশ্বেই এই রোগ পেয়ারার একটি প্রধান রোগ এবং এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনও প্রতিকার এখন পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। এরপরও সাম্প্রতিককালে এ রোগের কোনও প্রতিকার বের করা সম্ভব হয়েছে কিনা তা জানতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, যাতে সরেজমিনে যৌথভাবে বাগান পরিদর্শন করে প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। না হলে চাষিদের মাঠে ‘অন ফার্ম’ উচ্চতর গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। যাতে পেয়ারা বাগানগুলো রক্ষা পায়।”
তিনি আরও বলেন, ‘এ কথা সত্য যে দুই থেকে তিন বছরের বেশি বয়সী ফলবান গাছ এ রোগে বেশি মারা যাচ্ছে। যদি সমন্বিত কৌশলগুলো আমরা অবলম্বন করতে পারি তাহলে অবশ্যই পেয়ারা গাছের এই অকাল মড়ক আমরা শিগগিরই রোধ করতে পারবো।’