ঘুমের মধ্যেও কাঁদেন তারা

নজরুল ইসলাম, আখতারা বেগম, বিলকিস আরা বানু ও হাসান ইমাম

নজরুল ইসলাম ও হাসান ইমাম ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অবসরে যাওয়ার পরে স্ত্রীদের নিয়ে নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন তারা। বিমানে করে রওনা হন দুই পরিবারের চারজন। কিন্তু এক বছর আগে ১২ মার্চ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান চারজনই। রাজশাহীতে লাশ হয়ে ফিরে এসেছিলেন তারা। এই দুই জোড়া দম্পতি ছাড়াও রাজশাহীর মেয়ে বিলকিস আরা মিতুও বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। তার লাশ দেশে নিয়ে এসে ঢাকায় দাফন করা হয়। কেমন আছেন তাদের স্বজনরা?
রাজশাহী নগরীর উপ-শহর এক নম্বর সেক্টরে বাড়ি নিহত মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম ও আখতারা বেগমের। তাদের দুই মেয়ে ঢাকায় থাকেন। তাই মাঝে মধ্যে মেয়েদের কাছে গিয়ে ঢাকায় থাকতেন তারা। নজরুল ইসলামের জামাতা অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, ‘বাবা-মাকে হারানোর শোকে দুই মেয়েই ঘুমের মধ্যেও কান্না করে। ঘুম থেকে ওঠেও কাঁদে। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার কিছুই করার থাকে না। নভেম্বরে আমাদের প্রথম ছেলে সন্তান হয়েছে। আমার স্ত্রী বেডরেস্টে ছিল। তাই অনেক দিন রাজশাহীতে যাওয়া হয়নি। তবে গত মাসে রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কবর জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল করা হয়েছিল।’
ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে ইমরান হোসেন জানান, শ্বশুর-শাশুড়ির মহদেহের জন্য ৪১ লাখ করে গত মাসে মোট ৮২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে তাদের। অথচ ওই সময়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ অনেক অর্থের কথা বলা হয়েছিল। তবে কর্তৃপক্ষ তা দেয়নি।
নিহত মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম ও আখতারা বেগমের বড় মেয়ে নাজনীন আক্তার কাঁকন বাবা-মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুঠোফোনে ঢাকা থেকে বলেন, ‘আমরা দুই বোন বড় হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাচ্চাদের মতো আমাদের আদর করতেন মা-বাবা। তারা রাজশাহী থেকে প্রত্যেক দিন ফোনে সকাল-বিকাল আমাদের খোঁজ-খবর নিতেন। তারা মারা যাওয়ার পর সে অভ্যাসের কারণে এখনও সকাল-বিকাল বাবা-মায়ের ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম। পদে পদে বাবা-মায়ের অভাব অনুভব করি।’
আগামীকাল নতুন চাকরিতে যোগ দেবেন কাঁকন। তিনি জানান, ‘বলার ভাষা নেই। অনেক খুশির সংবাদ আসছে। কিন্তু প্রথমে যাদের জানাবো তারাই আজ নেই। আমার ছেলেটাকে নিয়ে কত আদর সোহাগ দিয়ে মানুষ করতো। খুনসুটি করতো। কিন্তু সবকিছু থেমে গেছে।’

তার ছোট বোন নার্গিস আক্তার কনক উত্তরা উইমেন মেডিক্যাল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। কনক বলেন, ‘এখনও বাবা-মায়ের কথা মনে হলে রাতে ঘুমাতে পারি না। তারা এভাবে আমাদের ছেড়ে যাবেন ভাবতেও পারি না। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় তাদের কথা ভাবলেই।’
নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত রাজশাহীর পাঁচজন বাসিন্দার মধ্যে ছিলেন নগরীর নওদাপাড়া গোলাম কিবরিয়ার মেয়ে বিলকিস আরা মিতু। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক গোলাম কিবরিয়া। মিতু রাজশাহীতে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাবেন কথা ছিল। কিন্তু আর ফেরেননি তিনি। সেই থেকে এখনও পথ চেয়ে বসে আছেন বাবা গোলাম কিবরিয়া। বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত নায়েক গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এখনও অনেক রাতে স্বপ্নে দেখি মেয়ে বাসায় এসেছে। আমাদের সঙ্গে হাসছে, গল্প করছে। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলেই দেখি সবই দুঃস্বপ্ন। এই স্বপ্ন আর কখনও বাস্তবে রূপ নেবে না। তারপরও মন মানে না। তাই আজও পথ চেয়ে বসে থাকি হয়তো মেয়েটি আমার বাসায় আসবে। জানি সে কোনও দিনও আসবে না।’

গোলাম কিবরিয়া জানান, তার মেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিউইয়র্কে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তার বাড়িতে আসার কথা ছিল। এরপর বাসায় না এসে নেপালে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন মিতু। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মারা যান তিনিও।
রাজশাহী নগরীর শিরোইলে ‘জননী’ নামের ১৭২ নম্বর বাসার ছয় তলায় একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতেন নিহত দম্পতি হাসান ইমাম (৬৫) ও বেগম হুরুন্নাহার বিলকিস বানু। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব হাসান ইমাম ও কলেজ শিক্ষক বিলকিস বানুর অবসরটা আনন্দেই কাটছিল। দুই ছেলে কায়সার ইমাম ও তৌকির ইমাম থাকেন কানাডায়। বিলকিস বানুর ভাই রাজশাহী বরেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ আলমগীর মালেক বলেন, ‘নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় আমার বোন ও দুলাভাই মারা গেছেন। কিন্তু এখনও আমরা পথ চেয়ে থাকি তাদের আশায়। কিন্তু তারা তো আর আসবেন না। তাদের এই শূন্যতা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। বই পাগল দুলাভাইয়ের বাড়িতে বইগুলো এখনও থরে থরে সাজানো আছে। শুধু তারাই নেই।’

আরও পড়ুন- 


‘এই কষ্ট কাউকে বোঝানো যাবে না’

ল্যান্ডিংয়ের সময় এখনও ভয়ে আঁতকে ওঠেন শাহরীন