ভাষা সৈনিকের নামের স্টেশনটি এখন গোয়ালঘর

খয়রাতনগর রেলস্টেশননীলফামারী সদরের সোনারায় ইউনিয়নের উলোটপাড়া গ্রামে ভাষা সৈনিক খয়রাত হোসেনের নামে নামকরণ করা ‘খয়রাতনগর রেলওয়ে স্টেশনে’  ট্রেন এখন আর থামে না। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের পদচারণা না থাকায় গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে স্টেশন চত্বর। এতে অর্থনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন এখানকার মানুষ। শুধু তাই নয়, রাতের অন্ধকারে স্টেশনে বসে মাদকের আখড়া। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। 

খয়রাত হেসেন মহান ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ও যুক্তফ্রট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর। তার নাম অম্লান রাখতে এই স্টেশনটির নামকরণ করা হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে স্টেশনটি। এই স্টেশনে এখন আর থামে না লোকাল বা আন্তঃনগর ট্রেন।খয়রাতনগর রেলস্টেশন

একই ইউনিয়নের স্টেশন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ও ফল বিক্রেতা আমজাদ হোসেন জানান, ১৯৯৬ থেকে খয়রাতনগর ও দারোয়ানী রেলওয়ে স্টেশন একাধারে বন্ধ রয়েছে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে ওই স্টেশন দুটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বগিতে বসে টিকিট দিতো। এরপর সেটিও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।’

একই কথা বলেন উলোটপাড়া স্টেশনের পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা অনাথ চন্দ্র রায় (৬৯)।খয়রাতনগর রেলস্টেশন

সরেজমিন দেখা যায়, স্টেশন চত্বরে অবস্থিত আধা পাকা টিন শেডের কক্ষগুলো গোয়ালঘরে পরিণত হয়েছে। আর রাত হলেই চলে নেশার আসর। তবে এখানে যে একসময় স্টেশন ছিল তার চিহ্ন বহন করে চলেছে টিকিট কাউন্টার, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ ও যাত্রীদের বিশ্রামাগার। এসব এখন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই।

ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা আরমান হোসেন জানান, ২০-২৫ বছর আগে খয়রাতনগর স্টেশনে সব ধরনের ট্রেন থামতো এবং হাজারও মানুষ উঠানামা করতেন। কাউন্টারে এতোই ভিড় ছিল, লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া টিকিট কাটা যেতো না। ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠতে হতো। এখান থেকে পার্শ্ববর্তী খানসামা, পাকের হাট, বীরগঞ্জ ও রানীর বন্দর এলাকার যাত্রীরা সৈয়দপুর, ভবানীপুর, পাবর্তীপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন হাট-বাজারে মালামাল আনা-নেওয়া ও যাতায়াত করতেন। এছাড়া, এলাকার মানুষ শীত মৌসুমে নতুন আলু, টমেটো, গাজর, মুলা, বেগুন ও কপি নিয়ে বিক্রি করতে যেতেন খুলনায়। খুলনার লোকজন এই পথে নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, চিলাহাটি ও জলঢাকা থেকে বিভিন্ন পণ্য আনা-নেওয়া করতেন।খয়রাতনগর রেলস্টেশন

এলাকার নিপেন্দ্র নাথ রায় (৫৬) জানান, ঢাকা শ্যামবাজার থেকে ট্রেনে করে আসতেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। খয়রাতনগর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে দারোয়ানীসহ আশপাশ এলাকার সবজি কিনে ঢাকায় নিয়ে যেতেন তারা। সেই ঐতিহ্যবাহী স্টেশনটি বন্ধ হওয়ার পর সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রমও স্থগিত হয়ে যায়। স্টেশনকে ঘিরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে স্থানীয়ভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়ে পড়েছে।

ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ‘দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান ভাষা সৈনিকের নামে নামকরণ করা স্টেশনটি বন্ধ হবে এটি এলাকাবাসীর কাম্য নয়। স্টেশনটি পুনরায় চালুর দাবি জানাই আমরা। স্টেশনের পাশেই উত্তরা ইপিজেডের অবস্থান। শ্রমিকরা ট্রেন ব্যবহার করে নিরাপদে দূরদূরান্তরে যাতায়াত করতে পারবে এই পথ ধরে। এছাড়া স্টেশনটি ব্যবহার করে উত্তরা ইপিজেডের উৎপাদিত পণ্য ট্রেনে করে বিভিন্ন স্থানে আনা ও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এটি উত্তরা ইপিজেডের সম্ভাবনাময় রেলওয়ে স্টেশন। তাই স্টেশনটি চালু করে আধুনিক মানসম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানাই।’খয়রাতনগর রেলস্টেশন

প্রয়াত খয়রাত হোসেনের নাতি ইমরান বিন হাসনাত জানান, ‘দাদুকে স্মরণীয় করে রাখতে স্টেশনটি আবারও সচল করা দরকার। তাই স্টেশনটি চালু করে আধুনিক মানসম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানাই। প্রয়াত খয়রাত হোসেন শুধু ভাষা সৈনিক ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীই নন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মমতাজুল হক জানান, ভাষা সৈনিক খয়রাত হোসেনকে  স্মরণীয় করে রাখতে স্টেশনটি আবারও সচল করা দরকার। তাই স্টেশনটি চালু করে এই এলাকার জীবনযাত্রায় গতি আনতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী জানান, ‘দারোয়ানী ও খয়রাতনগর স্টেশন দুটি চালুর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটি রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তাই একটু সময় লাগতে পারে।’