রেললাইনের পাশে অবৈধ দোকানপাটের কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা

রেললাইনের দুই পাশে অস্থায়ী বাজার ও ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের এক নম্বর রেলগেটের ফলপট্টি এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার প্রধান কারণ রেললাইনের দুই পাশের দোকানপাট।

তবে এটিকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির নেতারা। নগরীর ট্রাফিক সিস্টেম ভেঙে পড়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ তাদের। সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) সরেজমিনে দেখা গেছে, রেললাইনের দুই পাশে অস্থায়ী বাজার ও ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের কারণে মূলত সরু সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এই যানজট মাঝেমধ্যে রেলক্রসিং পর্যন্ত চলে যায়।

একই অবস্থায় রবিবার (২৭ ডিসেম্বর) রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ট্রেনের ধাক্কায় চার জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন ওই এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম (৫৫), মেসবাহ উদ্দিন (৬৫) ভুট্টরাম দাস (৫১) এবং রিফাত (৭)।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের এক নম্বর রেলগেট এলাকার পাঁচ গজের ভেতরে রয়েছে কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড, ট্রেন স্টেশন, ফলপট্টি, পাইকারি বাজার, নিত্যপণ্যের বাজার ও দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রেলস্টেশনের পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে মাছের বাজার। রয়েছে বাসস্ট্যান্ড ঘেঁষে লঞ্চঘাট ও পাইকারি সুতা ও কেমিক্যাল বেচাকেনার মোকাম টানবাজার। ফলে প্রতিনিয়ত এই এলাকায় হাজার হাজার মানুষ যাতায়ত করে। দিনরাত মানুষের জটলা লেগেই থাকে সড়কে। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদা দিয়ে নগরীর নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কের কালিবাজার থেকে এক নম্বর রেলগেটের ফলপট্টি পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে অবৈধ দোকানপাট। আরেক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ভ্যানগাড়ি। এসব ভ্যানগাড়ি ও ফুটপাত থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ কেনাকাটা করে। এই সড়ক দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে আসতে হয় সব পরিবহনকে। বাসস্ট্যান্ড ছোট হওয়ায় রাতে রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ করে রাখা হয় বাসগুলো।

এদিকে, শহরের দুই নম্বর রেলগেট থেকে এক নম্বর রেলগেট পর্যন্ত বসে অসংখ্য দোকানপাট। রয়েছে মৌসুমি ফল, সবজি ব্যবসায়ীদের ভ্যানগাড়ি। বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। সপ্তাহ না যেতেই আবারও রেললাইনের দুই পাশে বসে দোকানপাট।

রবিবারের দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতিদিনের মতো রবিবার সন্ধ্যায়ও ছিল তীব্র যানজট। একদিকে মানুষ ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে কেনাকাটা করছিল অন্যদিকে এক নম্বর রেলগেট গোল চত্বরে এলোমেলোভাবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। এ সময় আনন্দ পরিবহনের একটি বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য রেললাইনের ওপর ওঠে যায়। কিন্তু বাসের সামনে-পেছনে যানজট থাকায় কোনও দিকে সরতে পারছিল না। তখন ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি বাসকে ধাক্কা দেয়। বাসটিকে অন্তত ৪০ গজ দূরে নিয়ে যায় ট্রেনটি। বাসের নিচে চাপা পড়ে ফুটপাতের হকার এবং এক পথচারী নিহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুই জনের মৃত্যু হয়। এ ঘট্নায় অন্তত ১০ জন আহত হন।

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানদার মো. রাসেল মিয়া বলেন, আমাদের সচেতনতার অনেক অভাব। ট্রেন হুইসেল দেওয়ার পরও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে রেললাইন পার হন। অনেক সময় বেরিয়ারের নিচ দিয়ে মানুষ যাতায়াত করেন। ট্রেন আসার সিগন্যাল দেওয়ার পরও গতকাল বাস এসে রেললাইনের ওপরে ওঠে যায়। দুই দিকে যানবাহন থাকায় কোনও দিকে সরতে পারেনি বাসটি। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক ভূঁইয়া দীপু বলেন, ঘটনা ঘটলেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তারপর আর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।  

তিনি বলেন, নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়; হত্যাকাণ্ড। কারণ রেলগেট সংলগ্ন বাজার, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, ট্রেন স্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন মানুষকে আসতে হয়। হাজার হাজার মানুষ কেনাকাটা করে। ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি।

নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের মাস্টার কামরুল ইসলাম বলেন, ট্রেন আসার বার্তা পেয়ে গেটম্যান বেরিয়ার ফেলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এর আগেই বাস রেললাইনের ওপর ওঠে যায়। ফলে বেরিয়ার ফেলা যাচ্ছিল না। নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে প্রবেশের রুটটি অনেক বাকা। দূর থেকে ট্রেন দেখা যায় না।  

নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবুবক্কর বলেন, মৃত চার জনের মধ্যে দুই জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুই জনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে। তাদের লাশও হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

তিনি বলেন, রেলের ডাবল লাইনের কাজ চলছে। এটি চালু হলে রেল দুর্ঘটনা কমে আসবে। অভিযান চালিয়ে রেললাইনের দুই পাশের দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেবে দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী, কি কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। আশা করি, সব তথ্য উঠে আসবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সেই আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।