দেশের ১৬৮ বছরের পুরনো গণগ্রন্থাগার

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি ভবন পরিত্যক্ত, অধিকাংশ অংশ দখল

গ্রন্থাগারকে বলা হয় ‘জনতার বিশ্ববিদ্যালয়’, যেখান থেকে সাধারণ মানুষ আগ্রহ থাকলে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায়। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে যখন গণগ্রন্থাগার ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৩৫ সালে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ১৮৫০ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট অব ইংল্যান্ড’ পাস হওয়ার পরের সময়কে বলা হয়ে থাকে ‘পাবলিক লাইব্রেরি মুভমেন্ট’। কারণ এই আইনের ফলে তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে গণগ্রন্থাগার, যার ছোঁয়া লাগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গেও। ১৮৫৪ সালে বগুড়া, যশোর, বরিশাল ও রংপুরে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলা ট্রিবিউনের চার জেলার প্রতিনিধিরা সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন দেশের ১৬৮ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক গণগ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান অবস্থা। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস (৫ ফেব্রুয়ারি) উপলক্ষে এই বিশেষ আয়োজন। 

রংপুর শহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে কয়েকটি ভবন মিলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ব্যাপ্তি ছিল। স্থানীয়দের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ১৯০০ দশকে এখানে টাউন হল নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালের পর এর পেছনে গড়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমি ভবন। গণগ্রন্থাগার চত্বরেই নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার।  

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারির শুরুর পর দুই বছর ধরে গণগ্রন্থাগারটি বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ ও চেয়ার-টেবিল না থাকায় এখন আর এটি চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তারা জানান, করোনা মহামারির আগে শুধু ৭টি জাতীয় দৈনিক ও একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা পড়তে এখানে মূলত বয়স্করা আসতেন। 

অধিকাংশ অংশ দখল
গণগ্রন্থাগারের বরাদ্দকৃত জায়গার একটি অংশ দখল করে সর্বাধুনিক শিল্পকলা একাডেমির ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মূল ভবনের একটি অংশে রংপুর ফাউন্ডেশন ও রংপুর সাহিত্য পরিষদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমানে গণগ্রন্থাগারের দুটি ভবন, যার একটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অন্যটিতে বই সংরক্ষিত আছে। এছাড়া আরেকটি ভবনে সভা-সমাবেশ করার জন্য ছোট পরিসরে একটি মিলনায়তন আছে, সেটিও বন্ধ।

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি এখনও বেসরকারি একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২১ জন সদস্য এই কমিটিতে আছেন। বর্তমানে এর সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাহিত্যিক আকবর হোসেন। এভাবে ঐতিহাসিক গণগ্রন্থাগারটি দখল হয়ে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির পেছনে ৫৫ শতক জায়গায় শিল্পকলা একাডেমি ভবন তৈরি করা হয়েছে। তারা নির্মাণের আগে ক্ষতিপূরণ দেবে বলেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও দেয়নি।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১০ সালে সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৩২ জন এবং ২০১১ সালে ছিলেন ২২৮ জন। পরের বছরগুলোর আর কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৯০ জন আজীবন সদস্য থাকার একটি তথ্য পাওয়া যায়। এখানে যে কেউ আজীন সদস্য হওয়ার আবেদন করতে পারেন। এজন্য ৫ হাজার টাকা এককালীন দিতে হয়।

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি

বইয়ের সংখ্যা
এখানে মোট বইয়ের সংখ্যা ৫ হাজার ২৮২টি। এর মধ্যে ইংরেজি ভাষায় ১৯০০ শতকের পাঁচটি জার্নাল রয়েছে। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি কমিটির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন বলেন, ‘গণগ্রন্থাগারে ৬ হাজার বই আছে। এর মধ্যে দুই হাজার প্রাচীন আমলের বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সেগুলো রক্ষায় বাইন্ডিং করে বস্তাবন্দি করে রাখা হয়েছে। আলমারিসহ বই রাখার প্রয়োজনীয় জায়গা না থাকায় সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় মূল ক্ষতি
মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির। এটি রাজাকারদের ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই প্রতিষ্ঠাকালীন অধিকাংশ মূল্যবান বই-জার্নাল চুরি হয়ে যায় কিংবা ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

আকবর হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এখানে ৩০ হাজারেরও বেশি বই ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকাররা হাজার হাজার বই আগুনে পুড়িয়ে রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেছে।’

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি

মূল ভবন এখনও পরিত্যক্ত
গণগ্রন্থাগারে পাঠক ফিরিয়ে আনতে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উন্নয়ন বলতে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির বাইরে দেয়ালে রঙ ও নতুন সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ মূল ভবন এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, কোনও সংস্কার হয়নি। গণগ্রন্থাগারে শতবর্ষ আগের দুটি বড় টেবিল আছে, যেগুলো ব্যবহার হয় না। বর্তমানে লাইব্রেরিতে চেয়ার নেই, টেবিল নেই। বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু খুবই অপ্রতুল।

এ প্রসঙ্গে আকবর হোসেন বলেন, ‘আমরা রংপুর গণপূর্ত প্রকৌশলীদের দিয়ে নকশা ও সম্ভাব্য বয়ের হিসাব করে তিন দফা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। অনেক চেষ্টা করেও ঐতিহাসিক এই গণগ্রন্থাগারকে রক্ষা করতে পারছি না।’ 

এদিকে জেলা প্রশাসক ও রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি কমিটির সভাপতি আসিব আহসান বলেন, ‘গণগ্রন্থাগারটি সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি, তারা পদক্ষেপ নেবেন।’

** ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি

** দেড় যুগ ধরে বন্ধ থাকা বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি সচল করতে নেই উদ্যোগ

** বগুড়ার উডবার্ণ সরকারি গণগ্রন্থাগারে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া