বিশ্বকবির স্মৃতি ধ্বংস করে দিলো ‘রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়’ কর্তৃপক্ষ!

বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত মাটির ভবনটি ভেঙে ফেলেছে কমিটি, আছে কেবল একটি দেয়ালনওগাঁর রানীনগর উপজেলার রাতোয়াল গ্রামে ‘রবীন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়টির’ চারটি মাটির কক্ষ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ভেঙে ফেলেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জমিদারি দেখাশোনার জন্য ১৮৮৫ সালে কবিগুরু যখন এ এলাকায় এসেছিলেন তখন তার পৃষ্ঠপোষকতায় এই শ্রেণি কক্ষগুলো তৈরি হয়েছিল।

এছাড়া কক্ষের টিনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এখানে কবিগুরুর ব্যবহৃত ও স্মৃতি বিজড়িত অনেক আসবাবপত্র বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম ঐতিহ্যবাহী এই কক্ষগুলো সংস্কারের জন্য গত বছর টিআর প্রকল্পের দুই টন চাল অনুদান দেন। তারপরও তা সংস্কার না করে ভেঙে ফেলা হয়েছে।

বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে শিক্ষকদের বেতনভাতা বাবদ প্রায় দুই লাখ টাকা প্রদান ও শ্রেণিকক্ষে ২৪টি সিলিং ফ্যান লাগানোসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজের বিবরণ লিখে এলাকায় লিফলেট বিতরণ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষক লিফলেটে এইসব ভুয়া কাজের কথা লিখে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। 

জানা গেছে, ১৮৮৫ সালের শুরুর দিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া কালীগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশুনার জন্য রাতোয়াল গ্রামে আসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রজাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে শিক্ষার প্রয়োজন। এই উপলব্ধি থেকেই সেই সময় কয়েকজন পণ্ডিতের সহায়তায় তার নামে আদর্শ এই বিদ্যাপীঠের পথচলা শুরু। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যানেজার শ্যামানন্দ গুহ কালিগ্রাম পরগনার মূল জমিদারি (পতিসর স্টেট) দেখাশুনা করতেন এবং তার ছেলে নিত্যানন্দ গুহ (নিতাই বাবু) দেখাশুনা করতেন (সাবস্টেট) এই এলাকা। তাদের সার্বিক সহযোগিতায় রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী পণ্ডিত, শমসের আলী আকন্দ, কফিল আলী আকন্দ এবং এরফান আলী আকন্দকে নিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়।

বিদ্যালয়টি তৎকালীন আজিজুল্লাহ আকন্দের বৈঠকখানায় শুরু হলেও পরবর্তীতে রবীন্দ্র স্টেটের নিজস্ব সম্পত্তির ওপর মাটির কয়েকটি ঘর তৈরি করে প্রাথমিকভাবে শিক্ষাদান শুরু হয়। তখন হেডপণ্ডিত হিসেবে রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী পণ্ডিতের ওপর বিদ্যালয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরও অনেকেই বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়টি ১৯১৩ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শান্তি নিকেতনের প্রতিনিধিরা। এছাড়াও দেশের মন্ত্রী, এমপি, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রবীন্দ্র গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকসহ নানা গুণীজনের বিভিন্ন সময়ে পা পড়েছে এ বিদ্যালয়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কেসি মহিদুল আলম (নিলু চৌধুরী) অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, দীর্ঘদিনের পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিত্যক্ত মাটির কক্ষগুলো প্রতি বছর সংস্কার করা ব্যয়বহুল যা বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জোগান দেওয়া অসম্ভব। এই কক্ষগুলো সংস্কারের জন্য সরকারিভাবে কোনও অনুদান পাওয়া যায় না। তাই রেজুলেশনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষকের সিদ্ধান্তক্রমে কক্ষগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং এর এক অংশ প্রাচীর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুকবর আলী বলেন, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে এই পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরাকীর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখানে বিশ্বকবির নামে মিলনায়তন তৈরি করা হবে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলম বলেন, বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত এই পুরাকীর্তি ভেঙে ফেলার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তাকে কেউ কিছু জানাননি। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের ভবন ভেঙে ফেলা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ। তিনি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, ‘তারা এই পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করার অধিকার রাখেন কিন্তু ভেঙে ফেলার কোনও অধিকার রাখেন না। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

/জেবি/টিএন/আপ-এফএস/