শিক্ষক উৎপল হত্যা

কাল ক্লাসে ফিরবেন সেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, নিরাপত্তায় পুলিশ

শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বন্ধ রয়েছে সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ। নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর শনিবার (২ জুলাই) স্কুলটি খুলে দেওয়া হবে। শুক্রবার দুপুরে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে এই কথা জানান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার। তবে সহকর্মী ও শিক্ষক হারানোর ক্ষত নিয়ে ক্লাসে ফিরবেন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। 

তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। আমরা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখতে সর্বোচ্চ কাজ করে থাকি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মনে করছেন তাদের সঙ্গেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। আসলে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কোনও সুযোগ নেই। আমাদের একটি টহল টিম স্কুলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়োজিত থাকবে। আমরা সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো। কোনও ঘটনা দ্রুত জানানোর জন্য-৯৯৯ এর পাশাপাশি পুলিশ সুপার (এসপি) তার নিজের মোবাইল নম্বরও সবাইকে দিয়েছেন।’

পুলিশ সুপার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের নিশ্চিত করতে চাই, এ ঘটনার ন্যায় বিচার হবে। যদি ইভটিজার থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেকোনও জায়গায় এরকম কিছু থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পুলিশকে দ্রুত জানাতে হবে। প্রভাবশালীদের চাপে এ ঘটনা ভিন্নখাতে প্রভাবের কোনও সুযোগ নেই। এ সুযোগ অতীতেও ছিল না। প্রধান আসামি জিতুর বয়স তার সঠিক জন্ম সনদ অনুযায়ী আমরা জমা দেবো। এখানে কোনও সন্দেহ নেই।’

স্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস শাহী বলেন, ‘কিশোর গ্যাং থাকলে তালিকা করবেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি জড়িত থাকে তাদের বিষয়েও আমাদের জানাবেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে সেটি সমাধানের জন্য পুলিশ প্রশাসন এখানে এসেছেন। তারা নিশ্চিত করেছেন প্রতিদিন একবার হলেও পুলিশের টহল টিম এখানে আসবে। আতঙ্ক ত্যাগ করে ভবিষ্যৎ গড়তে কাজ করতে হবে।’

শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, অভিভাবকেরাও শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। আমারা এসব ব্যবহারে ব্যথিত হই। আমরা চাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ত্রিমুখী সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর হোক।’

তানিয়া আক্তার নামে আরেক শিক্ষিকা বলেন, ‘সবসময় আতঙ্কে থাকি। এই এলাকায় ইভটিজিংয়ের প্রভাব আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে বাসায় ফিরতে পারবো কি না এ সংশয় সবসময় আমাদের তাড়া করে। যে পরিমাণ ইভটিজিংয়ের প্রভাব বিস্তার তা দমনে পুলিশের নজর দেওয়ার অনুরোধ জানাই।’

অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরও উৎপলকে পাথর মেরেছিল। পরে তিনি আমাকে বলেন এবং ছাত্রদের ক্ষমা করে দেন। গত কয়েকদিন আগে তাকে দেখে ছাত্ররা বলে উৎপল আসছেন। তিনি বলেছিলেন আমার পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সম্ভব হবে না। এখানে বখাটে কিছু ছেলে আছে যারা বাইরে থেকে এসে উসকানি দেয়। শিক্ষার্থীরা এসব থেকে বিরত থাকতে হবে। শিক্ষক উৎপল হত্যা ছিল মধ্যযুগীয় আলোচিত বর্বরতা। যিনি শিক্ষাদান করেছেন তাকেই হত্যা করা হয়েছে। এ রকম হলে গোটা পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসবে। তাকে এমনভাবে পেটানো হয়েছে, প্রতিটা শিক্ষকের কলিজা টুকরো টুকরো হয়েছে। কিডনি অচল হয়ে গেছে। স্ক্রিনে দেখেছি, তিনি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। একজন মানুষ মারা যেতেই পারে। কিন্তু এভাবে মৃত্যু কাম্য নয়। সামান্য স্বার্থের জন্য ছাত্ররা তাকে হত্যা করবে কেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ব্যর্থতার সঙ্গে স্বীকার করছি, আমরা নিরাপত্তাহীতায় ভুগছি। ৯০ ভাগ শিক্ষক এই এলাকার বাইরের, শিক্ষার্থীরাও বাইরের। কলেজের পক্ষ থেকে উৎপলের মায়ের জন্য এফডিআরের ব্যবস্থা করা হবে। তার মা মাসে চার হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। উৎপলের মায়ের মুখের বিলাপ আর দেখতে চাই না। তিনি যেন মনে করেন আমার সন্তান মরে গেলেও ওই কলেজে আরও সন্তান রয়েছে।’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) হুমায়ুন কবির, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুল ইসলাম, আশুলিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামান, আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিয়াউল ইসলামসহ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষক উৎপল হত্যার ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করেছেন। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। সবশেষ মঙ্গলবার (২৮ জুন) রাতে আশুলিয়া থানা পুলিশ জিতুর বাবা উজ্জ্বল হাজীকে কুষ্টিয়া এবং বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) মূল অভিযুক্ত জিতুকে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতার আসামিদের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

উল্লেখ্য, শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শিক্ষক উৎপলকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করেন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র জিতু। পরে স্থানীয়রা শিক্ষককে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সোমবার (২৭ জুন) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর সোয়া ৫টার দিকে তিনি মারা যান।