আড়াই বছরের সময় চলে গেছেন বাবা, নিলুফাকে খেলোয়াড় বানালেন মা

নিলুফার বয়স যখন আড়াই বছর তখন বিচ্ছেদ হয় মা-বাবার। তার ছোট বোনের বয়স তখন মাত্র দেড় মাস। সে সময় যেন অথৈ সাগরে পড়ে যান তাদের মা বাছিরন আক্তার। কিন্তু দমে যাননি তিনি। কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকায় কুঠিপাড়ার চরে মায়ের বাড়িতে ওঠেন। তিনি স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি নেন। সামান্য বেতনে চলতে থাকে সংসার।

এমন পরিস্থিতিতে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুই মেয়েকে বড় করেছেন বাছিরন। তার বড় মেয়ে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ী দলের সদস্য নিলুফা ইয়াসমিন নিলা। নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ দল। ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখেছে বাংলাদেশের মেয়েরা।

কুষ্টিয়া পৌরসভার বর্ধিত জুগিয়া সবজি ফার্মপাড়ায় নিলুফার বাড়ি। আধাপাকা টিনশেড ঘরে নিলুফার মা বাছিরন আক্তার আর ছোট বোন সুরভী আক্তারকে নিয়ে তার সংসার। দুই মেয়েই মা বাছিরনের সম্বল। জানা যায়, বাছিরনের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। অল্প দিনেই রিকশাচালক স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান।

বাছিরন আক্তার বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে খেলাধুলায় নিয়মিত মুখ ছিলেন নিলুফা। শহরের চাঁদ সুলতানা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। দৌড়, লং জাম্পসহ বিভিন্ন খেলায় পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে ফিরতেন।’

খেলাধুলায় মেয়ের সাফল্য দেখে বাছিরনও খুশি হতেন। তাই কখনও খেলতে যেতে মানা করেননি। যদিও প্রতিবেশীরা টিপ্পনী কেটে বলতেন, ‘মা হয়ে মেয়েকে খেলায় পাঠায়!’ স্কুলে পড়ার পাশাপাশি সাভারে ফুটবল অ্যাকাডেমিতেও খেলতেন নিলুফা। ধকল সইতে না পেরে একবার কুষ্টিয়ায় ফিরতে চেয়েছিলেন নিলুফা। কিন্তু মায়ের বারণ। যত কষ্টই হোক না কেন, থাকতে হবে। হাল ছাড়া যাবে না।

বাছিরন বলেন, ‘সংসারে অভাব-অনটন ছিল। অভাবে কষ্টে মানুষ করেছি। নিলুফা যদি কোনোদিক থেকে ভালো করতে পারে করুক। বাধা দেবো না। মানুষ যত খারাপ বলে বলুক, শেষ দেখে ছাড়বো।’

এসএসসির পর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজে ভর্তি হন নিলুফা। সেখান থেকেই এইচএসসি পাস করেন। এরপর খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কয়েক বছর আগে ফুটবলে পাকিস্তানকে হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে নিলুফা অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ওই টাকা দিয়ে তিনি জমি কিনেছেন। যে বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল, সেটা নিলুফার উপার্জনেই তৈরি। এক কথায় সংসারের পুরো খরচ নিলুফা মেটাচ্ছেন।

বাছিরন আক্তার জানান, সোমবার বেলা ১১টার দিকে নিলুফা বাড়িতে ফোন করেছিলেন। বলেছিল, ‘দোয়া করো মা। খুব টেনশন হচ্ছে। নামাজ পড়ো আর কালকে মঙ্গলবার রোজা রেখো। মেয়ের কথামতো আজ রোজা রেখেছি।’

তিনি আরও জানান, গতকাল সন্ধ্যায় ফোনে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখেছি। নিলুফা ফাইনালে মাঠে নামেনি। তবে এতে আফসোস নেই। দলের সব মেয়েই আমার মেয়ে। সংগ্রামে মেয়ে বড় হয়েছে। আমার মেয়েদের বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। এটা আমার গর্ব।