দুর্গোৎসবের আনন্দ নেই ভাঙনকবলিত ৩ শতাধিক পরিবারে

৩০ বছর ধরে পদ্মার তীরে সংসার করছেন মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সম্ভুহালদারকান্দি গ্রামের সুমতি রানি ও নারায়ণ চন্দ্র। প্রতি বছর দুর্গাপূজার আগে আগে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। কিন্তু এ বছর তাদের মনে উৎসবের ছোঁয়া লাগেনি। পদ্মার থাবায় ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব তারা বলছেন, অনাহারে-অর্ধাহারে খোলা আকাশের নিচে যেখানে তাদের দিন কাটছে, সেখানে মায়ের জন্য শঙ্খধ্বনি বাজবে কীভাবে?

সুমতি রানি বলেন, ‘৩৫ বছর আগে পদ্মার পাড়ে আমার বিয়ে হয়। সুখেই কাটছিল আমাদের সংসার। কিন্তু কয়েক দিন আগে আমাদের ভিটেমাটি সর্বনাশা পদ্মা গিলে খাইছে। এখন আমাদের যাওয়ার জায়গাটাও নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাবো?’ 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় পূজা দুর্গাপূজা, কিন্তু ভাগ্য খারাপ। প্রতিবছর এই পূজায় ঘরের সবাই মিলে অনেক আনন্দ করি। এবার পূজায় কোনও প্রস্তুতি নেই। ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাকও কিনে দিতে পারিনি। এবার পূজা তো করতে পারবো না, সেই সঙ্গে কোথায় যাবো, কোন জায়গায় থাকবো ঠিক নেই। সরকারের কাছে দাবি, আমাদের যেন থাকার মতো একটা জায়গা দেয়।’

মুন্সীগঞ্জ-২

ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে আজ। ষষ্ঠী থেকে দশমী প্রতিদিনই নানান আয়োজনে চলবে উৎসব। কিন্তু উৎসবের আমেজ নেই মুন্সীগঞ্জে পদ্মার ভাঙনে ভিটেমাটি ও বসতঘর হারানো তিন শতাধিক  হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারে।

নদীর দিকে তাকিয়ে সম্ভুহালদারকান্দি গ্রামের গৃহবধূ কবিতা রানী দাস বলেন, ‘এইখানেই আমাদের শত বছরের শিব মন্দিরটি ছিল। চোখের সামনে বিলীন হয়ে গেছে, রক্ষা করতে পারিনি। যখন মন্দিরটি নদীতে পড়ে তখন আমাদের যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। সবাই কান্নাকাটি করছিল। দুর্গাপূজা এবার মনে হয় করতে পারবো না। কারণ সব সময় ভাঙন আতঙ্কে থাকি। রাতেও ঘুমাতে পারি না। বেঁচে থাকলে পূজা-অর্চনা সবই করতে পারবো।’

প্রায় দুইশ’ বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সহাবস্থান পদ্মার তীরের সম্ভুহালদারকান্দি ও সর্দারকান্দি গ্রামে। দুইশ’ বছরের সম্প্রীতির বন্ধন ছিন্ন করেছে কীর্তিনাশা পদ্মা। মসজিদের পাশে যে শিব মন্দিরটি ছিল সেটি এখন পদ্মার গর্ভে। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে গ্রামের মসজিদটিও।

মহেশপুর গ্রামের মঞ্জু রানী বলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেটা টাকাসহ আমার দুটি ঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন মেয়ের বিয়ে দেবো কীভাবে? আমার আগে যেখানে ঘরবাড়ি ছিল এখন সেই জায়গা দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলছে। আমার স্বামী অসুস্থ। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। কী করবো জানি না। পূজা বলতে কিছুই করতে পারবো না। আমি এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানাই, তিনি যেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন।’

মুন্সীগঞ্জ-৩

একই গ্রামের নেছার আলী বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বয়স প্রায় ২০০ বছর। আমরা ছোট থেকে এখনও এই গ্রামে মিলেমিশে একত্রে বসবাস করছি। কোনো দিন আমাদের সঙ্গে হিন্দু সম্পদায়ের কারও বিবাদ হয়নি। এই গ্রামে মসজিদের পাশে একটি মন্দির ছিল। সেটা কয়েকদিন আগে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। মসজিদটিও আছে ভাঙন ঝুঁকিতে। আমরা ছোট থেকে মন্দিরে পূজা হলে সেখানে যেতাম। হিন্দু পরিবারগুলোও আসতো আমাদের সুখে-দুখে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এইবার পূজার তেমন প্রস্তুত নেই তাদের। ভাঙন এলাকা থেকে খানিকটা দূরে দুর্গাপূজা হচ্ছে। তবে সেখানে তেমন আয়োজন নেই। কারণ যারা পূজা করে তাদের অধিকাংশ পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা চাই সবাই সবার মতো করে পূজা-অর্চনা করুক। প্রধানমন্ত্রী কাছে দাবি জানাই, এখানে একটা স্থায়ী বাঁধের ব্যবস্থা যেন করে দেন তিনি। তাহলে আমরা হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে বসবাস করতে পারবো।’

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ননি গোপার জানান, পূজা উদযাপন পরিষদের একটা সভা করা হবে। ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের কীভাবে সহায়তা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মুন্সীগঞ্জ-৪

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সমর ঘোষ বলেন, ‘প্রতি বছরেরর মতো এবারও বাংলাবাজার ইউনিয়নের শম্ভু হালদার কান্দি এলাকায় শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই এলাকায় কিছু মানুষ পদ্মা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কিছু মানুষের মাঝে শাড়ি-লুঙি বিতরণ করবো। আমাদের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস উপস্থিত থেকে তাদের মাঝে শাড়ি, লুঙি ও কিছু নগদ অর্থ বিতরণ করবেন।’

দফায় দফায় ভাঙনে ইতোমধ্যে পদ্মা তীরবর্তী দুটি গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বসতবাড়ি হারিয়ে অনেকের দিন কাটছে খোলা আকাশের নিচে। কেউবা আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।

মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫২০ মিটার এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধে জিওব্যাগ ফেলার কাজ অব্যাহত রয়েছে। জিওব্যাগ ফেলার পরে ভাঙনের তীব্রতা কিছুটা কমে আসলেও পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। এ কারণে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।