দেশীয় প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সচল হওয়া ডেমু ট্রেন চলবে ৯ অক্টোবর থেকে

দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়া থাকা চীনা প্রযুক্তিতে নির্মিত ডেমু ট্রেন অবশেষে দেশীয় প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সচল হয়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে এটির চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সচল হওয়া একটি ডেমু ট্রেন আগামী ৯ অক্টোবর থেকে রংপুর-পার্বতীপুর রুটে চলাচল শুরু করবে।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহীর সহকারী চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পি) (পশ্চিম) মো. আব্দুল আওয়াল ডেমু ট্রেন চলাচলের সিদ্ধান্তের কথা জানান।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৯ অক্টোবর থেকে পার্বতীপুর-রংপুর রুটে একটি ডেমু ট্রেন চলাচল করবে। সময়সূচী অনুযায়ী প্রতিদিন বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে যাবে, সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে রংপুরে পৌঁছাবে। আবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে রংপুর থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে পার্বতীপুরে পৌঁছাবে। চলাচলকারী ট্রেনটির কর্মদক্ষতা সন্তোষজনক হলে ভবিষ্যতে পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর, পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া ও কাউনিয়া থেকে কুড়িগ্রাম রুটেও চলাচল করা হবে।

রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চীন থেকে ২০১৩ সালে ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি ডেমু ট্রেন নিয়ে আসা হয়েছিল। এগুলো পরিচালিত হতো এক ধরনের বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এসব ট্রেনের ২০ বছর মেয়াদ ধরা হলেও আমদানির মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যেই একের পর এক সেগুলো বিকল হতে থাকে। ৯ বছরের মধ্যে ২০টি ডেমু ট্রেনই বিকল হয়ে পড়ে।

চীনের তানশাং ইন্টারন্যাশনাল এবং ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউড ডেমু ট্রেনগুলো নির্মাণ করে। ডেমু ট্রেনের পুরো নাম ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য এগুলো আমদানি করা হয়। এগুলোর দুই দিকে দুইটি ইঞ্জিন এবং মাঝখানে ৩০০ যাত্রীর বসার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া দাঁড়িয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। এসব ডেমু ট্রেন পরিচালিত হয় এক ধরনের বিশেষ কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এসব সফটওয়্যারের বিষয়ে চীনা কোম্পানি বিশেষ গোপনীয়তা অবলম্বন করে। ট্রেন হস্তান্তর করা হলেও এই সফটওয়্যার হস্তান্তর করা হয়নি কিংবা এ সম্পর্কে দেশীয় প্রকৌশলীদের অবগতও করা হয়নি। প্রতিটি ট্রেনে ৪০টি মডিউল রয়েছে। এসব মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়া রয়েছে। কোনও মডিটউল বিকল হলে সেই মডিউল পরিবর্তনের সময় সফটওয়্যারও সেটআপ  দেওয়া হয়। যার প্রতিটি মডিউলের দাম প্রায় সাত লাখ টাকা। এসব মডিউল সেটআপ দিতো চীনা প্রকৌশলীরা। ফলে ক্রয়ের পাশাপাশি পারিশ্রমিক ব্যয়ও ছিল। ট্রেনগুলো বিকল হওয়ার পর নতুন নতুন মডিউল স্থাপন ও সফটওয়্যার সেটআপ দিতে হিমশিম খেয়ে পড়ে রেলওয়ে বিভাগ। ফলে বিকল হওয়া ডেমু ট্রেনগুলো মেরামত করা হয়নি দীর্ঘদিনেও।

এরইমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জুর-উর-আলম ট্রেনগুলোকে সচল করতে দেশীয় প্রকৌশলীদের দ্বারস্থ হন। এগিয়ে আসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী এবং আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী  আসাদুজ্জামান। তিনি গবেষণা করেন ডেমু ট্রেন নিয়ে। তার নেতৃত্বে প্রকৌশলীরা গত বছরের ২ এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করেন। দেড় বছরের চেষ্টায় মাত্র ৭২ দিন কাজ করে চীনা প্রযুক্তিকে সরিয়ে ফেলে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ডেমু ট্রেন সচল করা হয়।

ডেমু ট্রেনটি মেরামত চলাকালেই ২৯ বার ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রী লোড ছাড়া ২৭ বার এবং যাত্রী লোড নিয়ে দুই বার পঞ্চগড় ও লালমনিহাটের পথে চালানো হয়েছে। এতে করে লোড, গতি, পরিচালনা সবকিছুই ঠিকঠাক দেখতে পান সংশ্লিষ্টরা। গত ৪ সেপ্টেম্বর একটি ডেমু ট্রেন পার্বতীপুর থেকে পঞ্চগড় রুটে ট্রায়ালে সফল হয়।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০টি ডেমু ট্রেন সচল করতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। আর দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরচ পড়বে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এই টাকা বরাদ্দ পেলে আগামী তিন মাসের মধ্যেই ২০টি ডেমু ট্রেন সচল করা সম্ভব।

চীনের টেকনোলজি জটিল ছিল, সেটি সহজ করতে এই প্রক্রিয়া। এতে করে দেশীয় প্রযুক্তিতে এসব ডেমু ট্রেন পরিচালিত হলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে।