রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে! যারা শুনছেন, তারাই একনজর ঈগলটি দেখতে ভিড় করছেন। প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের চিকিৎসকরাও মাঝেমধ্যে খোঁজ নিচ্ছেন শরীরস্বাস্থ্যের। কেউ কেউ আবার পাখিটির জন্য নিয়ে আসছেন মাছ। পাখি নিয়ে এই মাতামাতির ঘটনাটি কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার। সপ্তাহ দুয়েক আগে আহত ঈগলটি উদ্ধার করেন কয়েকজন তরুণ। তারাই এখন সেবা-শুশ্রূষা করছেন। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া ও নিরাপত্তার সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তারা। পাখিটিকে সুস্থ করে তুলতে তরুণদের এই প্রচেষ্টা প্রশংসা পাচ্ছে লোকজনের কাছে।
বত্রিশ এলাকার বাসিন্দা সরকারি চাকুরে মো. ফেরদৌস আজিজ জানালেন, প্রায় দু-সপ্তাহ আগে শিকার ধরতে গিয়ে মারাত্মক আহত হয় ঈগলটি। শত চেষ্টা করেও উড়তে পারছিল না। আহত ঈগলটিকে উদ্ধার করে কয়েকজন তরুণ নিয়ে যান প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, পাখিটি সুস্থ হতে বছরখানেক সময় লাগবে। এর পর থেকে ঈগলের দেখাশোনা ও সেবাযত্ন তারাই করছে।
ওই তরুণদের একজন সৈকত সরকার। তার ওষুধের ব্যবসা রয়েছে। পাখিটির উদ্ধার তৎপরতা এবং এর সেবাযত্ন সম্পর্কে তিনি জানান, বত্রিশ এলাকায় প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের আশপাশেই থাকতো ঈগলটি। বয়স বেড়ে যাওয়ায়, খুব বেশি ওড়াউড়ি করতো না। সহজ শিকারগুলোই কেবল ধরে ধরে খেতো। তবে কয়েকদিন আগে শিকার ধরতে গিয়ে গুরুতর আহত হয় পাখিটি। শিকার তাড়া করে হাসপাতালের দেয়ালে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। ডানা ঝাপটে এপাশ-ওপাশ করলেও, আর উড়তে পারেনি। দৃশ্যটি ধরা পড়ে তাদের চোখে। তারাই ধরাধরি করে ঈগলটিকে নিয়ে যান প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে। এরপর থেকেই তাদের মায়ায়, আতিথ্যে চলছে ঈগলের সেবাযত্ন ও চিকিৎসা।
স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের নৈশপ্রহরী ওমর ফারুক পাখিটির খাওয়া-দাওয়া, সেবাযত্ন ও চিকিৎসা নিশ্চিত করছেন। তিনি বলেন, ‘পাখিটিকে আমরা মুক্তভাবে রেখেছি। নিজের মতো করে হাঁটাচলা করছে।’ চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বয়স বেড়ে যাওয়ায় ঈগলের পালকগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। চিকিৎসা ও খাবার পেলে, পুরনো পালকগুলো ঝরে যাবে এবং নতুন পালক গজাবে। পরে আবার উড়তে পারবে পাখিটি। এই প্রক্রিয়াটি শেষ হতে বছরখানেক লাগবে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যত দিন লাগুক আমরা পাখিটিকে সুস্থ করে তুলবো।’
‘একটা পাখির জীবন বাঁচানোও কম কথা না। তাই এর সেবা করছি আমরা। এটিই আমাদের মনের শান্তি। আমরা চাই ঈগলটি সুস্থ হয়ে আবার উড়ে যাক তার নিজ ভুবনে, মুক্ত আকাশে। আর এজন্য আমাদের যা করতে হয়ে সবাইকে নিয়ে তা-ই করবো।’ কথাগুলো পাখিপ্রেমী আরেক তরুণ আব্দুল্লাহ আল মামুনের। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মাসুদ আহমেদ বেশ কয়েকদিন ধরে ঈগলটির গতিবিধি লক্ষ করছেন। তিনি জানালেন, ‘যারা পাখিটিকে দেখাশোনা করছে, তাদের প্রতি পাখিটিও আলাদা টান অনুভব করছে। তারা চলে গেলে কেমন যেন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। আবার ফিরে এলে একটা চাঞ্চল্য দেখা যায় ওর আচরণে। শরীরী ভাষার একটা পরিবর্তন দেখা যায়। দৌড়ে তাদের কাছে চলে আসে। পাখা ঝাপটায়। নানা অঙ্গভঙ্গি করে।’
কিশোরগঞ্জ জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. মো. সাইফুল ইসলাম পাখিটির চিকিৎসা করছেন। তিনি বলেন, ‘ঈগল একটি শিকারি পাখি। বয়স বেড়ে গেলে একসময় এটি আর উড়তে পারে না। তখন সে বেঁচে থাকার জন্য লোকালয়ে থাকার চেষ্টা করে। যেখানে সহজে খাবার পাওয়া যায়। এ পাখিটি তেমন কোনও রোগে আক্রান্ত না। বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে গেছে। বছরখানেক পরিচর্যা ও চিকিৎসা পেলে আবার উড়তে পারবে পাখিটি। তবে পাখিটির প্রতি স্থানীয় তরুণের অনুরাগ ও ভালোবাসা দেখে আমার ভালো লেগেছে। প্রতিটি প্রাণীর প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা থাকলে জীববৈচিত্র্য উপকৃত হবে। মানুষও ভালো থাকবে।’