গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: আতঙ্কে দিন কাটছে কলোনির বাসিন্দাদের

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা টপস্টার পোশাক কারখানা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনার পর আতঙ্কে দিন কাটছে ওই কলোনির বাসিন্দাদের। অপরিকল্পিত ঘনবসতি নির্মাণের ফলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।

ঘটনার পর থেকেই ওই বাড়ির মালিক সফিকুল ইসলামের ঘর তালাবদ্ধ রয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবরেও আতঙ্কে রয়েছেন সেখানে বসবাসকারীরা।

গত বুধবার (১৩ মার্চ) ইফতারির আগমুহূর্তে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নারী ও শিশুসহ ৩৬ জন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ জন শিশু এবং ২ জন নারীসহ বুধবার (২০ মার্চ) সকাল পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়।

ঘটনার পর থেকেই ওই বাড়ির মালিক সফিকুল ইসলামের ঘর তালাবদ্ধ রয়েছেসরেজমিনে ঘটনাস্থল তেলিরচালা (টপস্টার পোশাক কারখানা) এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডের তৈরি ওই কলোনিতে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের বসবাস। স্বল্প বেতন ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ঘর ভাড়া কম থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছোট ছোট ওই সব কক্ষ ভাড়া নিয়ে সপরিবারে বসবাস করেন কারখানার শ্রমিকেরা। ১০ ফিট বাই ১০ ফিটের  কক্ষে বসবাসের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারে তিন বেলা রান্নার কাজ করেন তারা। তিতাস গ্যাস সংযোগ না থাকায় ওই সব পরিবারের বাসিন্দারা প্রায় প্রত্যেকেই সিলিন্ডার গ্যাসের মাধ্যমে রান্নার কাজ করেন। কাউকে কাউকে আবার মাটির চুলায়ও রান্না করতে দেখা গেছে।

অগ্নিদগ্ধ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থলে দেখতে গিয়ে আমি অগ্নিদগ্ধ হয়েছি। আর্থিক সমস্যার কারণে চিকিৎসা নিতে পারছি না। আমাদের আগামী ঈদ আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম পরিবারের সঙ্গে গ্রামে গিয়ে ঈদ উদযাপন করবো। অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। স্ত্রীর বেতনের টাকায় কোনোভাবে চিকিৎসা চলছে। আমার সঙ্গে পরিবারের সবার ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে গেলো।’

পোশাকশ্রমিক আমীর হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে আমরা এখানে আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছি। বাড়তি লাভের আশায় বাড়ির মালিকেরা ছোট ছোট ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা সিলিন্ডার গ্যাসের আগুন যদি কোনও একটি কক্ষে লাগে তাহলে পুরো এলাকাটি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এখানে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে সরু রাস্তা দিয়ে বের হতে গিয়ে পায়ে পিষ্ট হয়েই অনেকে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের বেতন কম তাই অল্প টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়ায় এখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করি।’

১০ ফিটের  কক্ষে বসবাসের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারে তিন বেলা রান্নার কাজ করেন তারাঅপর বাসিন্দা শাপলা খাতুন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবরে আমাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। এলাকাটি ঘনবসতি হওয়ায় যেকোনও দুর্ঘটনায় সরু রাস্তা থাকায় বাসিন্দাদের দৌড়ে বের হতে সমস্যা হবে। সময়মতো উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও কলোনির ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছি আমরা।’

অগ্নিদগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া শিশু গোলাম রাব্বির (১১) বাবা শাহ আলম বলেন, ‘মা মরা ছেলে রাব্বি স্কুল ছুটি থাকায় আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল। সিলিন্ডার গ্যাসের লিকেজ থেকে আগুনে দগ্ধ হয়ে আমার ছেলেটার মৃত্যু হয়।’

তিনি বলেন, ‘বাড়ি মালিক সফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী গ্যাস সিলিন্ডারের বোতল নিয়ে ঝগড়া করেন। একপর্যায়ে সফিকুল সিলিন্ডার বোতল বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলে শো শো শব্দে গ্যাস বের হতে থাকে। পাশে মাটির চুলায় এক নারী রান্না করছিলেন। সেখান থেকেই বিস্ফোরিত হয় গ্যাস সিলিন্ডার। আশপাশে থাকা অগ্নিদগ্ধ নারী-শিশু সকলেই জীবন বাঁচাতে আহাজারি করতে করতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। সেখানে আমার ছেলে রাব্বি অগ্নিদগ্ধ হয়ে মাটিতে পড়েন। পাঁচ দিন ওই হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যায় মা হারা ছেলেটা।’ একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের দাবি করেন শাহ আলম।

কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাওসার আহমেদ জানান, অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে দাফন-কাফনের জন্য বিশ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।