সময় পার হলেও ১৫১ ফাইল ছাড়েননি মাউশির ডিডি, দুদকের অভিযান

ফাইল ঢাকা পাঠানোর সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (মাউশি) রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক (ডিডি) ড. আলমগীর কবির তার টেবিলে থাকা ফাইল অগ্রগামী করেননি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ পেয়েছে, টাকা ছাড়া ফাইল অগ্রগামী করেন না ডিডি আলমগীর। এ অভিযোগে দুদকের একটি দল মঙ্গলবার (১১ মার্চ) তার দফতরে অভিযান চালিয়েছে। তখন দেখা গেছে, ১৫১টি ফাইল আটকে রেখেছেন ডিডি।

এই ফাইলগুলো বিভাগের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকদের নতুন এমপিওভুক্তির আবেদন, কলেজের এরিয়া বিল, ছুটি এবং বিদেশ ভ্রমণের এনওসির আবেদন। সবচেয়ে বেশি ফাইল কলেজের এরিয়া বিলের। আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে মাউশিতে ফাইল পাঠানোর সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। কিন্তু ১৫১টি ফাইল পড়ে আছে ডিডি আলমগীর কবিরের টেবিলেই।

গত ১০ মার্চ দুদকের হটলাইনে অভিযোগ যায় যে, মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ের কলেজ শাখার ডিডি আলমগীর কবির এ পদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুষ নিয়ে ফাইল অনুমোদন করেন। এমপিওভুক্তি এবং বদলির ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেন তিনি। ঘুষ না দিলে ফাইল ওপরে ওঠে না। ছুটি কিংবা অনাপত্তিপত্র নিতে গেলেও তিনি ঘুষ দাবি করেন। তার চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারলে তিনি ফাইল অনুমোদন করেন না। বর্তমানে (অভিযোগের সময় পর্যন্ত) তিনি ১৮৩টি ফাইল আটকে রেখে ঘুষ দাবি করছেন।

এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ফজলুল বারী একটি এনফোর্সমেন্ট টিম গঠন করে দেন। টিম লিডার করা হয় জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেনকে। সদস্য রাখা হয় সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ সিদ্দিক, উপসহকারী পরিচালক বোরহান উদ্দিন ও কোর্ট পরিদর্শক আশরাফুল ইসলামকে। মঙ্গলবার দুপুরে দুদকের এই এনফোর্সমেন্ট টিম মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ে অভিযান চালায়।

এ সময় দুদক দল দেখে, আলমগীর কবিরের টেবিলে আটকে আছে ১৫১টি ফাইল। এসব ফাইল প্রথমে পরিচালক মোহা. আছাদুজ্জামানের কাছে দাখিল হয়েছে। তারপর তিনি সহকারী পরিচালক আলমাস উদ্দিনের কাছে পাঠান। আলমাস উদ্দিন তা উপপরিচালক আলমগীর কবিরের কাছে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আলমগীর কবির পরে আর তা অগ্রগামী করেননি। তিনি ফাইল অগ্রগামী করলে পরিচালক তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঢাকায় পাঠাতেন।

দুদক দলের কাছে আলমগীর কবির দাবি করেন, অসুস্থ অবস্থায় ছুটিতে থাকায় এবং তিন দিন সার্ভার ডাউন থাকায় তিনি ফাইল ছাড়তে পারেননি। দুদক দল এ সময় তার কাছে লিখিত বক্তব্য চান। লিখিত বক্তব্য দিতে আগামী রবিবার পর্যন্ত সময় নিয়েছেন ডিডি আলমগীর। এসব বিষয়ে কথা বলতে বিকালে কয়েক দফা তাকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক মোহা. আছাদুজ্জামান বলেন, ‘আমার কাছে ফাইল আসার পর আমি সর্বোচ্চ ১০ দিন রাখতে পারি। সহকারী পরিচালক সাত দিন এবং উপপরিচালক পাঁচ দিন রাখতে পারেন। কিন্তু উপপরিচালক যথাসময়ে ফাইল ছাড়েন না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঢাকায় ফাইল পাঠাতে আমি তাকে ফোন করেছি, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেছি, এমনকি তার রুমে গিয়েও যেভাবে ভদ্রভাবে বলা দরকার বলেছি। তা-ও তিনি ছাড়েননি।

‘তার কাছে মোট ২৮২টি ফাইল ছিল। তার মধ্যে ১৭৪টি আটকে রেখেছিলেন। ঢাকায় পাঠানোর সময় শেষে তিনি ২৩টা ফাইল আমাকে দিয়েছেন। এসব ফাইল আর এখন নিয়ে আমার কোনও লাভ নেই, ঢাকায় পাঠানো যাবে না। আর ১৫১টি ফাইল তো তিনি ছাড়েনইনি।’

পরিচালক আরও বলেন, ‘মাঝে মাঝেই আমার কানে কথা আসে যে, যেসব ফাইল ডিডির টেবিলে আছে, সেগুলো অগ্রগামী করার জন্য “থার্ড পার্টি” কলেজের শিক্ষকদের ফোন করে টাকা চেয়েছে। আমি কয়েকটা নম্বর তাকে দিয়েছিও। কিন্তু ফোন করা ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন এই ফোন কলের সঙ্গে ফাইল আটকে রাখার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা তা জানি না।’

উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরে রাজশাহীর পবা উপজেলার ডাঙ্গেরহাট মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আসলাম আলী মাউশির আঞ্চলিক পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ করেন, ডিডির টেবিলে তার কলেজের ৪৩ জন শিক্ষক-কর্মচারীর ৯০ লাখ টাকা এরিয়া বিলের ফাইল আটকে আছে। এই ফাইল অনুমোদন করাতে ‘আমি মাউশি থেকে বলছি’ জানিয়ে এক নারী তাকে ফোন করে টাকা চেয়েছিলেন। তখন ফাইল আটকে রাখার কথা অস্বীকার করেছিলেন ডিডি।

আলমগীর কবীর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। মাউশির রাজশাহীর উপপরিচালক হিসেবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি প্রথম যোগদান করেছিলেন। তারপর তার বিরুদ্ধে অনিয়ম করে এমপিও দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগের তদন্ত চলাকালে তাকে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছিল।

কিন্তু তিনি আবারও মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্ববেতনে তিনি পরিচালক হওয়ার জন্য তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। তার আবেদনে সুপারিশ করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। এতে তিনি সচিবকে লেখেন, ‘শূন্য পদ সাপেক্ষে পদায়নের ব্যবস্থা নিন।’ কিন্তু কাম্য যোগ্যতা না থাকায় পরিচালক হতে পারেননি আলমগীর। এরপর চুপচাপ ছিলেন। আওয়ামী সরকারের পতনের পর তিনি আবার তৎপরতা শুরু করেন মাউশিতে ফেরার। ফলে দুর্নীতির অভিযোগে বদলির ৫ মাস ৭ দিনের মাথায় গত ১৮ নভেম্বর তাকে মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিডি হিসেবে পদায়ন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।

এবারও আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘তিনি ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ করেন না বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। ঘুষের জন্য তিনি ফাইল আটকে রাখেন বলেও আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। তাই আমরা এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়ে যাচাই করেছি। কোন তারিখে কোন ফাইল এসে আটকে আছে সেগুলো দেখেছি। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ১৫১টি ফাইল আটকে আছে। এ ব্যাপারে ডিডির লিখিত জবাব চাওয়া হয়েছে। তিনি রবিবার পর্যন্ত সময় চেয়েছেন। জবাব আসার পরে পর্যালোচনা করে আমরা ঢাকায় প্রতিবেদন পাঠাবো।’