মুজিববর্ষের ঘর গেলো ধনীদের হাতে!

বরগুনার আমতলীতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার হিসেবে হতদরিদ্রের ঘর দেওয়া হচ্ছে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের। যারা ঘর পাচ্ছেন তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা করে। আর এ অভিযোগ উঠেছে খোদ ইউএনওর বিরুদ্ধে। তারই প্রতিনিধি মো. সুজন ও হাবিব গাজী ঘরপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। টাকা না দিলে মিলছে না ঘরের নির্মাণসামগ্রী। বিষয়টি তদন্ত করার আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ণ প্রকল্প ২-এর অধীনে দ্বিতীয় ধাপে আমতলী উপজেলায় হতদরিদ্রদের জন্য ৩৫০টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের গুলিশাখালী ইউনিয়নে ৫০টি ঘর বরাদ্দ দেন ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান। সেগুলোর মধ্যে ইউএনও কার্যালয়ের টাইপিস্ট কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. এনামুল হক বাদশা তার নিজ গ্রাম হরিদ্রবাড়িয়া এলাকার লোকজনকে বরাদ্দ দিয়েছেন ৩০টি ঘর। ১৪টি ঘর পেয়েছেন বাদশার স্বজনেরাই! বাকি ১৬টিও পেয়েছেন এলাকার বিত্তশালীরা।

ঘর যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন- বাদশার মামাতো ভাই নিজাই জোমাদ্দার, ওবায়দুল জোমাদ্দার, শহীদুল জোমাদ্দার, সোহেল জোমাদ্দার, ভগ্নিপতি মো. ফকু হাওলাদার, ফুফাতো ভাই ফোরকান, চাচা সেরাজ মৃধা, বেয়াই রাহাত তালুকদার, হাবিব গাজী, সেলিম গাজী, চাচাতো ভাই নাসির গাজী, জাকির গাজী, নুর জামাল গাজী ও আলাউদ্দিন গাজী। এরা প্রত্যেকেই স্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও বাদশার কল্যাণে হাতিয়ে নিয়েছেন মুজিববর্ষের ঘর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামানের দুই প্রতিনিধি সুজন ও হাবিব গাজী ঘরপ্রতি ২০ হাজার টাকা আদায় করে বাদশার মাধ্যমে ইউএনওর হাতে পৌঁছে দেন। যারা টাকা দেন তাদের বাড়িতেই পৌঁছে যায় ঘর নির্মাণের সামগ্রী। টাকা না দিলে তালিকায় নাম থাকলেও কোনও সামগ্রী দেওয়া হয় না।

স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন আমতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। অনিয়মের বিষয়ে তিনি সবাইকে চুপ থাকার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ এলাকাবাসীর। তবে ইউএনও বলছেন, তিনি ভিন্ন কাজে সেখানে গিয়েছিলেন। কাউকে হুমকি দেননি। 

হরিদ্রাবাড়িয়া গ্রামের দরিদ্র বাসিন্দা ইমরান বলেন, ‘আমি এতিম হয়েও ঘর পেলাম না। যারা পেয়েছেন তারা বড়লোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে সুজন ও হাবিব গাজী ২০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। টাকা দিতে পারিনি। তাই ঘরও পাইনি।’

একই গ্রামের জাহাঙ্গির সিকদার, শানু আকন ও রুস্তুম মাস্টার বলেন, এই গ্রামে যারা ঘর পেয়েছেন তারা সকলেই ধনাঢ্য। এ ছাড়াও দরিদ্রদের মধ্যে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করার দাবি জানান তারা।

এসব অনিয়মের অভিযোগ এনে বরগুনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন কামাল রাঢ়ী নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হতদরিদ্রদের ঘর দিয়েছেন বিনামূল্যে। কিন্তু একটি পক্ষ এটাকে বাণিজ্য বানিয়ে ফেলেছে। তালিকা তৈরিতেও অনিয়ম করেছে। টাকা নেওয়ার অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কাছে আমি অভিযোগ দিয়েছি। আশা করি তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।’

এ বিষয়ে আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি মো. সুজন বলেন, ইউএনও’র নির্দেশে ঘরের নির্মাণকাজ তদারকি করছি। কোনও টাকা পয়সা নেইনি।

অফিস সহকারী এনামুল হক বাদশাও টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘যথা নিয়মেই ঘর বাছাই করা হয়েছে। নির্মাণকাজেও কোনও অনিয়ম হচ্ছে না।’

আমতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ছরোয়ার ফোরকান বলেন, আমাকে না জানিয়ে তালিকা তৈরি করছেন ইউএনও। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানদের চাহিদার ভিত্তিতে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারপরও বাদশার আত্মীয়দের ১৪টি ঘর দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টাকার নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি কেউ নিয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শুক্রবারের হুমকি দেওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘আমি ঘর পরিদর্শনে যাইনি। ফেয়ার প্রাইসে চাল দেওয়ার অনিয়মের তদন্তসহ বেশ কিছু কাজে গিয়েছিলাম। সেই সময় স্থানীয়দের বলি কেউ ঘরের বিষয়ে দুর্নীতি কিংবা টাকা আত্মসাৎ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঘরের তালিকা তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ স্বীকার করে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে উপকারভোগীদের তালিকা দ্রুত প্রকাশ করতে ইউএনওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।