কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পে ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা

মহামারি করোনায় চরম সংকটে পড়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকে মুখরিত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এখন জনশূন্য। এজন্য পর্যটনসংশ্লিষ্ট ১৬টি খাতের কয়েক হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। দিনের পর দিন খালি পড়ে আছে ছোট-বড় দুই শতাধিক হোটেল-মোটেল। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে শতকোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য ঋণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।

করোনার সংক্রমণ রোধে চলতি বছরের ১ এপ্রিল কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। চিরচেনা কুয়াকাটা এখন যেন স্থানীয়দের কাছেই অচেনা। অথচ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটায় থাকতো পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়।

কুয়াকাটায় হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ, খাবার রেস্তোরাঁ, সৈকত সংলগ্ন শপিং মল, ট্যুর অপারেটরদের কার্যক্রম, ফটোগ্রাফি, ফিসফ্রাই, বিচ বাইকসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ১৬টি খাত বন্ধ রয়েছে। এজন্য আয়-রোজগার না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এসব খাতের সঙ্গে জড়িতরা।

পর্যটকহীন সৈকত কুয়াকাটার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, কুয়াকাটা সৈকতকেন্দ্রিক বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ব্যাংক, এনজিওর ঋণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন শতাধিক হোটেল ব্যবসায়ী ও দেড় শতাধিক ট্যুরিজম ব্যবসায়ী। তাদের ভাষ্য, ঋণ পরিশোধে বিকল্প ব্যবসার চিন্তা করছেন অনেকেই। আবার অনেকেই হোটেল বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে চাইলেও ক্রেতা সংঙ্কটে তা পারছেন না। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ইতোমধ্যে নয় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতেও বাধ্য হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। তিন হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারীকে বেতন বন্ধ করে ছুটিতে পাঠিয়েছেন। আর যারা আছেন তাদেরও ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন না। বেতন না পেয়ে অসহায় হয়ে চরম অর্থকষ্টে পড়েছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।

কুয়াকাটার পর্যটন ব্যবসায়ী কে এম বাচ্চু বলেন, ‘করোনা মহামারির আগে কুয়াকাটায় দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটক আসতেন। কর্মচারীদের বেতন ও সব খরচ বাদে দিনে পাঁচ হাজার টাকা আয় হতো আমার। ছুটির দিনগুলোতে আরও বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটতো। তখন আরও বেশি আয় হতো। তাছাড়া প্রতি বছর দুই ঈদে লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম ঘটতো। আমার ২০ জন কর্মচারী। তারা সবাই ছুটিতে আছেন। তাদের বেতন দেওয়া দূরের কথা, ঋণের চাপে আমার সংসারই এখন চলছে না।’

FB_IMG_16231351004388904ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, ‘আমার ঋণ আছে ৭০ লাখ টাকা। ঋণ নিয়ে ট্যুরিজম ব্যবসা শুরু করি। প্রথমে ভালোই চলছিল। ঋণের কয়েকটা কিস্তিও দিয়েছি, সবকিছু ঠিক থাকলে এতদিনে শোধ হয়ে যেত। করোনা এস সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণের কিস্তি  দিতে না পারায় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মচারীরা ছুটিতে আছেন। তাদের বেতনও বন্ধ। আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি কোনও সহযোগিতা পাইনি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন হোটেলশ্রমিক বলেন, ‘কুয়াকাটায় হোটেল শ্রমিকের সংখ্যা ১৫ শতাধিক। এর মধ্যে আট শতাধিকের চাকরি চলে গেছে। অনেককেই পাঠানো হয়েছে ছুটিতে, আর যারা আছেন তাদের অনেকেরই হোটেল মালিক বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন। মালিকের কাছে বেতন চাইলে বলেন, ব্যবসা বন্ধ- কীভাবে বেতন দেবো। স্ত্রী-সন্তানের তিন বেলা খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা।’

VideoCapture_20201231-091214ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াকের) সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘কুয়াকাটায় এখন পর্যটক নেই। কঠোর লকডাউন দেওয়ায় কোনও পর্যটক আসেন না। স্থানীয় দর্শনার্থীরা এলেও ট্যুরিস্ট পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দীর্ঘদিন পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় আমরা মানবেতর জীবন-যাপন করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঈদ মৌসুমে আমরা লাভ-লোকসান হিসাব করে থাকি। দুই ঈদে টোয়াকের সেই হিসাব অনুসারে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শুধু টোয়াকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরই এই ক্ষতি হয়েছে।’ তিনি জানান, টোয়াকের মতো আরও দুটি সংগঠন রয়েছে।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোতালেব শরিফ বলেন, ‘কুয়াকাটায় হোটেল-মোটেল রয়েছে প্রায় ২শ’র মতো। প্রতি মাসে হোটেল খাতে ক্ষতি হচ্ছে পাঁচ-সাত কোটি টাকা। লকডাউনে কুয়াকাটার পর্যটন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রণোদনার কোনও সহযোগিতা পাইনি আমরা। এমনকি বারবার ধরনা দিয়েও ঋণের সুদ মওকুফসহ ব্যাংক থেকেও ঋণ সহায়তা পাননি পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।’

FB_IMG_16209901204547289কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আব্দুল খালেক বলেন, ‘করোনার সংক্রমণরোধে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখন কুয়াকাটায় পর্যটক নেই। তবে ঈদের দিন পটুয়াখালী ও আশপাশের জেলার কিছু দর্শনার্থী এসেছিলেন। তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন পুরোপুরি পর্যটকশূন্য কুয়াকাটা।’

কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ছয় মাস ধরে বেকার অবস্থায় আছেন। তাদের ৮০ শতাংশ মানুষের সংসার অনেক কষ্টে চলছে। তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনও সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়নি। গরিবের জন্য পৌরসভায় ১০ টন চাল এসেছিল। কিছু শ্রমিকের তালিকা করে সেই চাল থেকে ১০ কেজি করে দিয়েছি। তালিকার লোকদের সবাইকে চাল দিতে গিয়ে আমার আড়াই লাখ টাকা নিজের থেকে দিতে হয়েছে। মহামারির মধ্যে বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। কুয়াকাটায় অনেক শ্রমিক আছেন কাজ নেই এবং ঘরেও চাল নেই। অন্য কোনও বিকল্প পেশায় তারা যেতে চাইছেন কিন্তু করোনায় সারা দেশে একই অবস্থা।’

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, ‘করোনা উপলক্ষে সরকারি যে বরাদ্দ আসছে তা প্রত্যেক ইউনিয়নে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। কুয়াকাটায় কিছু মানুষকে খাবার দিচ্ছে তিনটি সংগঠন, আমি ওই সংগঠনগুলোকে চাল দিয়েছি। ব্যবসায়ীরা কিন্তু লোকসানে নেই। বিগত দিনে তারা অনেক ব্যবসা করেছেন। এই দুঃসময়ে কিছু মালিক কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন, এমনকি খাবারও দিচ্ছেন না। এ সময়ে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদেরও সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। এর আগের লগডাউনে ১৭ কেজি করে ১৫০ প্যাকেট চাল দিয়েছি কুয়াকাটার শ্রমিকদের। কিন্তু কুয়াকাটায় শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছে আড়াই হাজারের উপরে। নতুন কোনও বরাদ্দ আসলে কুয়াকাটার সব শ্রমিককে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।’

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘করোনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমরা তাদের সবার জন্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। যদি কুয়াকাটার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’