এপিটাফে লেখা ‘অজ্ঞাত’, নমুনা পরীক্ষায় মিলবে পরিচয়

অভিযান-১০ লঞ্চে লাগা আগুনে পুড়ে ছাই দেহ। চিনছেন না স্বজনরাও। লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই, তাই পরিচয় মেলার আগেই দাফন। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুর্বিষহ মৃত্যুর চেয়েও যেন আরও বেদনাদায়ক ছিল এ দাফন। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বরগুনার পোটকাখালী গ্রামে খাকদোন নদীর পাড়ের গণকবরস্থল।

এভাবেই শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুর ১টায় অজ্ঞাত পরিচয়ের ২৩টি লাশ একে একে দাফন করা হয়েছে। তবে লাশ দাফন হলেও সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে নমুনা। করা হবে ডিএনএ পরীক্ষা। এরপর জানা যাবে পরিচয় এবং খোঁজ মিলবে স্বজনদের। যদিও তখন এসে কবর চিহ্নিত করা ছাড়া স্বজনদের আর বেশি কিছু করার থাকবে না। কবরের পাশেই গেঁথে দেওয়া হয়েছে একটি লাঠি। এর মাথায় লাগানো হয়েছে একটি বোর্ড। এটিকে এফিটাফও বলা যেতে পারে। যেখানে লেখা রয়েছে, ‘অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী। পরিচয়: অজ্ঞাত’। এর নিচেই লেখা জিডি নম্বর।

এদিকে, বরগুনা জেলা প্রশাসনের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী জেলার এখনও ১৬ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। হয়তো এ ২৩ জনের মধ্যেই রয়েছে তাদের লাশ।

দাফনের সময় আসা নান্না হাওলাদার বলেন, ‘আমার বোন সেদিন ঢাকা থেকে বরগুনা আসছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে যে লাশগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আমার বোন আছে কি-না তাও বুঝতে পারছি না। লাশগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে যে দেখে বোঝার উপায় নেই।’

স্বজনকে খুঁজতে থাকা কনু হাওলাদার নামের আরেকজন বলেন, ‘ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনার সব হাসপাতালে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও আমার ছেলে, তার বউ ও নাতিকে খুঁজে পেলাম না। বরগুনায় যে লাশ রয়েছে তাও সবগুলো ভালো করে খুঁজে দেখলাম, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না, কোথায় আমার আদরের ধনের লাশ। নাকি এখনও আমার ছেলের কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। আমার ছেলেরে আইন্না দেন।’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন হারানো এ মানুষটি।

৩০ জনের জানাজা একসঙ্গে

এ বিষয়ে ঝালকাঠির সিভিল সার্জন রতন কুমার ঢালী বলেন, ‘লাশগুলো বরগুনা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করার আগেই আমরা এখানে উদ্ধার ৩৭ লাশের নমুনা সংগ্রহ করে রেখেছি। যেকোনও আইনি প্রক্রিয়া কিংবা ডিএনএ পরীক্ষার জন্যই মূলত এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।’

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আজকে ২৩টি অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ দাফন করেছি বরগুনার পোটকাখালী গণকবরে। বরগুনায় লাশ সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে দাফন করা হয়েছে। তবে স্বজনদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আমরা প্রতিটি লাশে একটি ক্রমিক নম্বর ব্যবহার করেছি এবং সেই অনুযায়ী ঝালকাঠি স্বাস্থ্য বিভাগ সব লাশের নমুনা সংগ্রহ করে রেখেছে। কোনও স্বজন যদি তার নিখোঁজ প্রিয়জনদের খুঁজে না পান, তবে আমরা তারও নমুনা সংগ্রহ করে দাফন করা লাশের নমুনা মিলিয়ে শনাক্ত করবো।’

সদরঘাট থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে অভিযান-১০ লঞ্চ। এরপর থামে চাঁদপুর, বরিশাল ও দপদপিয়া ঘাটে। তিন ঘাটেই যাত্রীরা ওঠানামা করেছেন। দপদপিয়া থেকে লঞ্চটি ছাড়ে বেতাগীর উদ্দেশে। এর মাঝেই বাধে বিপত্তি। রাত ৩টায় সুগন্ধা নদীতে চলমান লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে আগুনের সূত্রপাত। পানিতে ভাসমান এই যানে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান। প্রাণে বাঁচতে যাত্রীরা ঝাঁপ দিতে থাকেন সুগন্ধা নদীতে। এতে অনেকে প্রাণে বাঁচলেও এখন পর্যন্ত ৩৭টি লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন শতাধিক। এদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। এ দুর্ঘটনায় মোট ৩৭টি লাশ উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে অজ্ঞাত ২৩ লাশ দাফন করা হয়েছে। পরিচয় মিলেছে এমন ১৪ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে প্রশাসন।