টাকা আয় নয়, মানবিক চিকিৎসক হতে চাই

‘সকাল থেকে রিকশা চালিয়ে বাবা চাল নিয়ে আসতেন বিকালে। রান্না করে ভাত খেতাম সন্ধ্যায়, ক্লান্ত শরীরে রাতে পড়তে পারতাম না। তবু অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। বাবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’ 

এভাবেই কথাগুলো বললেন বরিশালের বানারীপাড়ার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রিকশাচালক মিজানুর রহমানের মেয়ে সাদিয়া আফরিন হারিছা। এবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর যেখানে আনন্দিত হওয়ার কথা, সেখানে হারিছার পরিবারে বিরাজ করছে আর্থিক দৈন্যতা। সফলতা পেলেও মেয়েকে কীভাবে মেডিক্যালে ভর্তি করবেন, কীভাবে চলবে পড়াশোনা; এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে হতদরিদ্র পরিবারটি। 

অটোরিকশাচালক মিজানুর রহমান হাওলাদারের তৃতীয় কন্যা হারিছা। বড় মেয়ে মাস্টার্স, মেজো মেয়ে ডিগ্রি এবং ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে।

হারিছা বলেন, ‘শুরু থেকেই স্বপ্ন ছিল মানবিক চিকিৎসক হওয়ার। পরিবারে আর্থিক সংকট থাকায় প্রাইভেট পড়া, এমনকি ঠিকমতো পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। তবে প্রতিটি ক্লাসে মন দিয়ে শিক্ষকদের পড়া আয়ত্ত করতাম। স্কুল এবং কলেজশিক্ষকদের সবসময় সহানুভূতি পেয়েছি। অনেক কষ্ট করে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক সংকট। হয়তো কেউ সহায়তা করলে এই সংকট কেটে যাবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জ পদক এবং ৬৭টি সার্টিফিকেট পেয়েছেন হারিছা। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৭৮ নম্বর পেয়েছেন।

হারিছা বলেন, ‘গর্ব করে বলি আমার বাবা একজন রিকশাচালক। আগে বাবা তরকারি বিক্রি করে আমাদের সংসার চালিয়েছেন। তার আয় দিয়ে আমার এতদূর আসা। যত বাধাই আসুক আমি মানবিক চিকিৎসক হতে চাই। টাকা আয় নয়, চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখবো।’

তিনি বলেন, ‘দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারের সহযোগিতা করা দরকার। কারণ দেশে আমার মতো অনেক হারিছা রয়েছে। সরকার তাদের সহায়তা করলে কেউ চিকিৎসক, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে।’ 

হারিছার বাবা মিজানুর রহমান বলেন, ‘হারিছা ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। এজন্য স্বজনরা হারিছার লেখাপড়ায় সহায়তা করেছেন। মেডিক্যালে ভর্তির জন্য হারিছাকে বরিশাল রেখে কোচিং করিয়েছি। এজন্য আগের বাসা ছেড়ে টিনের ঘরের ভাড়া বাসায় উঠেছি। অনেক কষ্ট করেছি। হারিছাও পড়াশোনার জন্য অনেক কষ্ট করেছে। কখনও সন্তানদের ভালো খাবার দিতে পারিনি। কারণ আমার সামর্থ্য নেই। এ নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের কোনও দুঃখ নেই। হারিছার ফল প্রকাশ হওয়ার পর জানলাম রাজশাহী মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তখন থেকে একটাই দুশ্চিন্তা মনে, কীভাবে মেয়েকে ভর্তি করাবো। ভর্তি করালেও হোস্টেলে থাকা-খাওয়া ও যাবতীয় খরচ কীভাবে চালাবো। এসব নিয়ে চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।’

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির বিভাগীয় সমন্বয়ক অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল বলেন, ‘হারিছার দাবিটা যৌক্তিক। হতদরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য সরকারকেই উচ্চ শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। হারিছার মতো শিক্ষার্থীদের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।’