মধ্যরাতে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা, পরে জানা গেলো গুজব

বরিশালে মধ্যরাতে মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত পড়েছে’ বলে ঘোষণা নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল। পরে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, এটি ছিল গুজব। বুধবার (০৭ ডিসেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরিশালের পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম।

এর আগে মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, কাউনিয়া ও নগরীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত পড়েছে’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় মাইকে বলা হয়, ‘নগরীতে ডাকাত পড়েছে, আপনারা সতর্ক থাকুন।’ পরবর্তীতে নগরীর কয়েকটি পাড়া-মহল্লার মসজিদ থেকে একই ঘোষণা দেওয়া হয়। 

এই ঘোষণা দেওয়ার পরই প্রত্যেক এলাকার তরুণ ও নারী-পুরুষরা লাঠিসোঁটা হাতে সড়কে নেমে পড়েন। এমনকি নগরবাসী বাসার ভেতর লাঠিসোঁটা ও মরিচের গুঁড়া নিয়ে ডাকাত প্রতিহতের জন্য প্রস্তুত হন। এভাবে রাত দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত নির্ঘুম কাটান নগরবাসী। কথাগুলো বলেছেন খান সড়ক এলাকার বাসিন্দা হ্যাপী আক্তারসহ একাধিক গৃহবধূ।

এরপর শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সতর্ক করে লেখালেখি। পরিচিতজনদের মোবাইল করে খোঁজখবর নেওয়া হয়। রাত ২টায় এই প্রতিনিধির মোবাইলে দুজন ফোন করে ঘটনার সত্যতা জানতে চান। একইভাবে ৯৯৯ নম্বর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে মোবাইল করেছেন কেউ কেউ। তবে পুলিশ এর সত্যতা পায়নি।

নগরীর কাউনিয়ার বাসিন্দা সুমন আহমেদ বলেন, ‘খেলা দেখে ঘুমাতে যেতে অনেক রাত হয়ে যায়। রাত ২টার দিকে একাধিক মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল ডাকাত পড়েছে, আপনারা সতর্ক থাকুন। এরপর সতর্ক থাকার চেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আসল ঘটনা জানতে একাধিক স্থানে মোবাইল করি। কিন্তু কোথাও থেকে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।’

তিনি বলেন, ‘সবশেষ ফেসবুকে ও গণমাধ্যমে আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুই পাইনি। সকালে জানতে পারলাম বিষয়টি গুজব। গত কয়েকদিন জেলার কয়েকটি উপজেলায় ডাকাতি এবং ডাকাত আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই গুজব বাবুগঞ্জ ও উজিরপুর থেকে শুরু হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানতে পেরেছি।’

কাউনিয়ার বাসিন্দা নাজমুল হাসান ছবির বলেন, ‘গভীর রাতে মসজিদের মাইকে যখন বলা হয় ডাকাত পড়েছে তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কারণ এ ধরনের ঘোষণা নগরীতে এর আগে শোনা যায়নি। তবে কিছুদিন আগে বাবুগঞ্জ ও শিকারপুর বন্দরে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এজন্য নগরবাসীর মধ্যে ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে। মূলত গভীর রাতে মসজিদের মাইক থেকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা আসায় সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।’

বরিশাল জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘গভীর রাতে নগরীর বিভিন্ন মসজিদ থেকে ডাকাত পড়ার বার্তা প্রচার করা হয়। তবে তা কারও নির্দেশে নয়। বিভিন্ন মসজিদের মাইক থেকে এ ধরনের প্রচার শুনে আতঙ্কিত হয়ে স্ব স্ব মসজিদের মুয়াজ্জিনরা নিজ থেকে সতর্ক করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বুধবার সকালে একাধিক ব্যক্তি ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি বিষয়টি গুজব। এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি।’

উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা মাসুমুর রহমান বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপজেলায়। এরপর বিভিন্ন মসজিদ থেকে সতর্কবার্তা প্রচার করা হয়। প্রচারের পরপরই গ্রামবাসী যে যার মতো লাঠিসোঁটা ও বাঁশ নিয়ে বের হন। পরে লাইটের আলো জ্বালিয়ে বাঁশি বাজিয়ে ডাকাত খোঁজার কাজ শুরু হয়। এভাবে রাত ২টার পর্যন্ত চলে। এরপর যে যার মতো বাড়ি ফেরেন। তবে পুরো রাত কারও চোখে ঘুম ছিল না।’

বাবুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রাত ২টা থেকে উপজেলার বিভিন্ন মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার বিষয়টি প্রচার করা হয়। খবর পেয়ে গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে নামেন। ঘণ্টাব্যাপী চলে ডাকাত-ডাকাত বলে চিৎকার। রাত ৩টার দিকে গ্রামবাসী বাড়ি ফেরেন। এরপরও কেউ ঘুমাতে পারেননি। কারণ দুদিন আগে বাবুগঞ্জে এক বিয়েবাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এজন্য গ্রামবাসী মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার খবর শুনে প্রতিহত করতে সড়কে নেমে আসেন।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগরীর একাধিক ইমাম-মুয়াজ্জিন জানিয়েছেন, বিভিন্ন মসজিদের মাইকে এ ধরনের প্রচার শোনার পর তারা নিজ মসজিদের মাইকে নিজেদের অবস্থান থেকে সতর্কবার্তা প্রচার করেন। সবার উদ্দেশ্য ছিল নগরবাসীকে সতর্ক এবং ডাকাতদের প্রতিহত করা। অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।’

পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে আমরা জেনেছি, এটি গুজব ছিল। এই গুজব কীভাবে ছড়িয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একইসঙ্গে ডাকাত সন্দেহ হলে আইন হাতে তুলে না নিয়ে নিকটস্থ থানা পুলিশকে জানানোর জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ করা হচ্ছে।’

এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের পূর্ব ভুতেরদিয়া গ্রামে বিয়েবাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একই সময় উজিরপুরের শিকারপুর বন্দরে একাধিক দোকানে ডাকাতি হয়। ২৫-৩০ জনের ডাকাত দল আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করেছিল।