গত ৪ জানুয়ারি এমনই একটি অস্ত্রের কারখানার সন্ধান পান কক্সবাজারের র্যাব-৭ এর সদস্যরা। ওই কারখানায় অভিযান চালিয়ে কারখানা থেকে স্থানীয়ভাবে তৈরি ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২২ রাউন্ড গুলি ও ৩৩টি অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এসময় মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের মহিষের ডেইল এলাকার মৃত আজম উল্লাহর ছেলে আবদুল মাবুদ (৪০) ও একই ইউনিয়নের আহমদিয়া কাটা এলাকার কবির আহমদের ছেলে আবু তাহেরকে (৪২) আটক করা হয়। উদ্ধার হওয়া ২২টি অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১৪টি একনলা বন্দুক, ৬টি ওয়ান শুটার গান, একটি থ্রি কোয়ার্টার বন্দুক ও ১টি দেশীয় রাইফেল। ২২ রাউন্ড গুলি ছাড়াও ৩৩টি সরঞ্জামের মধ্যে ড্রিল মেশিন, বন্দুক পাইপ, রেত, প্লাস, ব্লেড, এয়ার মেশিনসহ বেশকিছু সরঞ্জাম রয়েছে।
মহেশখালীর পাহাড়ে সংঘবদ্ধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কারখানা গড়ে তুলে দেশীয় অস্ত্র তৈরি করছে বলে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারে র্যাব-৭ এর কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার আশেকুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘র্যাবের হাতে আটক আবদুল মাবুদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন পাহাড়ে আস্তানা তৈরি করে ছোট কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি অস্ত্র তৈরি করছেন। এসব অস্ত্র রোহিঙ্গা, জলদস্যু, ডাকাতের কাছে বিক্রি করে যাচ্ছেন তারা।’
আশেকুর রহমান আরও বলেন, ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গোয়েন্দা তৎপরতার ভিত্তিতে র্যাব অভিযান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। সিন্ডিকেট সদস্যদেরও গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয়দের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মহেশখালীর পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হচ্ছে দেশীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার দাগী সন্ত্রাসী ও দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো এসব অস্ত্র ব্যবহার করছে বেশি। এ কারণে দৈশীয় তৈরি অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং দাম বেশি পাওয়ায় এখানকার কারিগররা এই ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে রাত-দিন পরিশ্রম করে তারা বিভিন্ন রকমের দেশীয় অস্ত্র তৈরি করেই যাচ্ছে।
তবে র্যাব-পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে কিছু অস্ত্র ধরা পড়লেও অস্ত্র তৈরির মূল কারিগররা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রায় তিন বছর আগে এসব পাহাড়ে অস্ত্র কারখানায় অভিযানে গিয়ে সন্ত্রাসীর গুলিতে পুলিশের এসআই পরেশ কুমার কারবারি নিহত হন। এছাড়া অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে অনেক। গত দুই বছরে শুধু কালারমারছড়া ইউনিয়নেই সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন ১৩ জন। এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও ঘটে।
মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালীর বড় ডেইল, ছোট মহেশখালীর মরাঝিরি, কালারমারছড়ার ফকিরজুম পাড়া পাহাড়, সাতঘর পাড়া, শাপলাপুরের মৌলভীকাটা, পাহাড়ী জুমসহ কড়ইবনিয়া, পুটিরঝিরি, সারসিয়া, গুলুরবরঘোনায় বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ওইসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র। রাতের বেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে তারা দিনের বেলায় অস্ত্র তৈরি করাকেই বেশি নিরাপদ মনে করেন। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা তাদের একাধিক সোর্স থাকায় র্যাব, পুলিশ আসার আগাম খবর তারা মোবাইলের মাধ্যমে পেয়ে সতর্কবস্থায় থাকে। ফলে রাতে ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে না।
জানা গেছে, গহীন পাহাড়ে খোদাই করে দুই দিকে রাস্তা রেখে মনোরম পরিবেশে তারা ওয়ার্কশপের মতো করে এ অস্ত্র তৈরির কারখানাগুলো গড়ে তুলেছে। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের লোহার পাত, স্টীলের নল, ড্রিল মেশিন, গ্যাসের চুলা, কয়লা, লেইদ মেশিনসহ বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির যন্ত্রপাতি। একটি অস্ত্র তৈরি করতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হলেও সেটি স্থানীয়ভাবে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সাত-আট হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। আর এসব কারখানায় নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে কালারমারছড়া উত্তর নলবিলা এলাকার দাগী সন্ত্রাসী ও একাধিক মামলার ফেরারি আসামিদের। তাদের রয়েছে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। ওই নেটওয়ার্ক ফিশিং ট্রলার, লবণ বোঝাই গাড়ির পলিথিনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র সরবরাহ ও বিক্রি করে।
মহেশখালী থানায় যোগদান করার পর এ পর্যন্ত ৩৮টি অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানিয়ে ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল বণিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়ি অরণ্যে অস্ত্রের কারখানার কথা শোনা যায়। তবে কয়টি অস্ত্রের কারখানা রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় পুলিশ অভিযানে যাওয়ার আগেই অস্ত্র ব্যবসায়ী ও কারিগররা নিরাপদে সরে পড়েন। তবে গত ১০ মাসে এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়েছি এবং অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান এখনও অব্যাহত রয়েছে।’
আরও পড়ুন-
লিটন হত্যা নিয়ে যা ভাবেন পৌর মেয়র
/এফএস/টিএন/