প্লাস্টিকের ফুলে বাজার দখল, কমছে কাঁচা ফুলের চাষ

প্লাস্টিকের ফুলে বাজার দখল‘আকদ, গায়ে হলুদ ও বিবাহোত্তর সংধর্বনার দায়িত্ব দিয়েছিলাম একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে। ভেবেছিলাম কাঁচা ফুল দিয়ে তারা অনুষ্ঠানের সাজ-সজ্জা করবে। কিন্তু অনুষ্ঠানের সময় দেখা গেলো তিন পর্বের এই অনুষ্ঠান তারা সাজিয়েছে প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে। কাঁচা ফুলের সরবরাহ নেই এমন অজুহাতে তারা এসব অনুষ্ঠান প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে সাজায়’-কথাগুলো বলেছেন চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী এস এম আরিফুজ্জামান। যিনি সম্প্রতি বিয়ে করেছেন।

তরুণ এই ব্যবসায়ী বাংলা ট্র্রিবিউনকে বলেন, ‘কাঁচা ফুলের প্রতি যেই আগ্রহ বা ভালোলাগা আসে, প্লাস্টিকের ফুলে তা আসে না। তবুও দিন দিন প্লাস্টিকের ফুলের ব্যবহার বাড়ছে। অন্যদিকে কমছে কাঁচা ফুলের ব্যবহার। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টগুলো এখন প্রায়ই প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার করছে।’

একই ধরনের কথা বলেন চট্টগ্রাম নগরীর মোমিন রোডস্থ ফুলের দোকান ‘অপরাজিতার’ সত্ত্বাধিকারী কুতুব উদ্দিন।

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিকের একই ফুল বহুবার ব্যবহার করতে পারে তাই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায়ীরা সাজ-সজ্জার কাজে প্লাস্টিকের ফুল বেশি ব্যবহার করছেন। কম খরচে বেশি লাভের আশায় প্লাস্টিকের ফুলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে কাঁচা ফুলের ব্যবহার কমছে।’

প্লাস্টিকের ফুলতিনি আরও বলেন, ‘বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ফুল চাষিরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। লোকসানের কারণে অনেকে ফুল চাষ বন্ধ করে দিয়ে অন্য ব্যবসায় মনোযোগী হচ্ছেন।’

কাঁচা ফুলের সবচেয়ে বড় বাজার চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়। এই এলাকায় অর্ধ শতাধিক দোকানে পাইকারি ও খুচরায় কাঁচা ফুল বেচা-কেনা হয়। প্রতিদিন সকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাষি ও ব্যবসায়ীরা ফুল নিয়ে আসেন এই বাজারে। বিশেষ করে কক্সবাজারের চকরিয়া, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও যশোরের ঝিকরগাছার ফুলের জন্য বিখ্যাত এই বাজার।

সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আগের মতো ফুল বেচাকেনার বাজার বসেনি। দোকানের ফুলদানি, ফুলের তোড়াগুলোতে কাঁচা ফুলের পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে প্লাস্টিকের ফুল।

মোড়ের কয়েকজন ফুল দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক-দেড় বছর ধরে এখানে আর ফুলের বাজার বসে না। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও বেপারিরা কাঁচা ফুল নিয়ে আসে না। প্রতিদিন হাতেগোনা কয়েকজন বেপারি আসে ফুল নিয়ে।

ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীদের দাবি, একটি চক্র ব্যবসার নামে চীন ও থাইল্যান্ড থেকে প্লাস্টিকের ফুল আমদানি করে সম্ভাবনাময় ফুল চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গত দুই-তিন বছর ধরে কোন ধরনের আমদানি নীতি ছাড়াই দেশে প্লাস্টিকের ফুলের আমদানি ও ব্যবহার বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চাষি ও ব্যবসায়ীরা ঋণের জালে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বেন।

দীর্ঘ দুই যুগ ধরে ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা মঈনুল ইসলাম।

প্লাস্টিকের ফুলতিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন একর জমিতে গোলাপ ও দুই একর জমিতে গ্ল্যাডিওলাস চাষ করতাম। গত বছর কয়েক লাখ টাকা লোকসান দিয়ে এ বছর মাত্র ৪০ শতক জমিতে গোলাপ ও সমপরিমাণ জমিতে গ্ল্যাডিওলাস চাষ করছি। বাজারে প্লাস্টিকের ফুলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন কাঁচা ফুলের চাহিদা অনেক কম।’

তিনি জানান, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী গ্রামে প্রায় সাত-আটশ একর জমিতে ফুলের চাষ হয়। এরমধ্যে প্রায় ৩০০ একর জমিতে বিভিন্ন রঙের গোলাপ ও ২০০ জমিতে গ্ল্যাডওলাস চাষ হয়ে আসছে। বাকি জমিগুলোতে গাঁদা, জিনিয়া, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ও রজনীগন্ধাসহ অন্যান্য ফুলের চাষ হয়। কিন্তু গত এক বছরের ব্যবধানে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি জমিতে ফুলের চাষ কমে গেছে। আমদানিকৃত প্লাস্টিক ফুলে বাজার দখলের কারণে কাঁচা ফুলের চাহিদা কমে যাওয়ায় ফুল চাষ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন স্থানীয় চাষিরা।

বরইতলীর ফুল চাষি সুভাষ বাবু বলেন, ‘প্লাস্টিকের ফুলের প্রভাবে বাজারে কাঁচা ফুলের ন্যূনতম দামও পাওয়া যাচ্ছে না। ফুলের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চেরাগী মোড় এলাকায় আগে প্রতি একশ গোলাপ বিক্রি হতো সর্বনিম্ন ২০০ টাকায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসব ঘিরে প্রতি একশ ফুল ৪০০-৫০০ টাকা এমনকি ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সেই প্রতি একশ গোলাপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০-১০০ টাকায়।

দাম কম পাওয়ায় গত বছর শীত মৌসুমে প্রায় আট লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে বলে জানান এ চাষি। চাহিদা কমে যাওয়া ও ক্রমাগত লোকসানের ভয়ে চলতি বছর থেকে ফুল চাষ ছেড়ে দেবেন বলে মনস্থির করেছেন তিনি।

চট্টগ্রাম ফুল ব্যবসায়ী ও ফুল চাষি বহুমুখী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘চাষিরা নিজেদের মেধা, শ্রম আর টাকা খরচ করে দেশে ফুলের চাষ ও বাজার বাড়িয়েছে। কিন্তু ব্যবসার নামে প্লাস্টিকের ফুল আমদানি করে একশ্রেণির মানুষ কাঁচা ফুলের বাজারকে ধ্বংস করছে। এখনই এই প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে দেশে বিকাশমান ফুল চাষ ধ্বংস হয়ে যাবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আমিনুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি একটি সাময়িক হুমকি। কারণ ফুল বলতে মানুষ কাঁচা ফুলকেই বোঝে। যে ফুলে ঘ্রাণ আছে, সৌরভ আছে। প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে প্রয়োজন সারা যায় কিন্তু ওই ফুলগুলোর প্রতি ভালোলাগা কাজ করে না। তাই কাঁচা ফুলের চাহিদা কমবে না, বরং বাড়বে। ফুল সরবরাহ স্বাভাবিক এবং দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলে কাঁচা ফুলের চাহিদা অবশ্যই বাড়বে।’ 

আরও পড়ুন:
ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন: শঙ্কিত স্থানীয়রা