সংগঠনের চেয়েও নিজেকে বড় মনে করতেন রনি!

নুরুল আজিম রনি (ছবি: সংগৃহীত)এক কোচিং সেন্টারের মালিককে মারধরের দায় স্বীকার করে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। তবে তিনি নিজেকে সংগঠনের চেয়েও বেশি বড় মনে করতেন এবং সংগঠনের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের স্বার্থে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন বলে মনে করছেন মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ সংশ্লিষ্ট নেতারা।

গত ৩১ মার্চ এক কলেজ অধ্যক্ষকে কিল-ঘুষি মারা এবং সম্প্রতি এক কোচিং সেন্টারের মালিককে মারধরের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক সমালোচিত হন নুরুল আজিম রনি। পর পর এ দুটি ঘটনায় তাকে জড়িয়ে সংগঠনের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। দলের মধ্যেও তাকে নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়।  

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যক্তি রনি নিজেকে সংগঠনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করতো। তা না হলে তো সে আইনকে নিজের হাতে তুলে নিতো না।’ তিনি বলেন, ‘তার আগে অনেকে মহানগর ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলেন। কেউ তো তার মতো এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ করেননি। আমি নিজেও দুবার মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। অতীতে কোনও নেতাই এ ধরনের কাজ করেননি। রনি নিজেকে সংগঠন থেকে বড় মনে করতো, এ কারণেই সে এসব ন্যক্কারজনক কাজ করেছে।’কোচিং সেন্টারের মালিক রাশেদ মিয়াকে মারধর করেন রনি

আ জ ম নাছির উদ্দিন আরও বলেন, ‘দেশে আইন আছে, আইনের শাসন আছে। কেউ রনির সঙ্গে অন্যায় কাজ করলে সে আইনের আশ্রয় নিতে পারতো। যেখানে সাধারণ মানুষ আইনের আশ্রয় নিচ্ছে, সেখানে সে আইনের আশ্রয় নেবে না কেন? সে নগর ছাত্রলীগের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার সুযোগও তার বেশি ছিল। কিন্তু সে সেটি না করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। সে আইনকে সম্মান করেনি। সংগঠনের স্বার্থও দেখেনি। নিজের স্বার্থকে সে প্রাধান্য দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা কোনও দায়িত্বশীল পদে থাকেন, তাদের ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সংগঠনের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হয়। তার চলাফেরা, আচার-আচরণ সব কর্মকাণ্ডে সংগঠনের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রয়োজনে ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হবে। রনি সেটি করেনি।’

একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রনির মধ্যে অনেক সৃজনশীলতা ছিল। তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ যোগ্যতা ছিল। অনেক ভালো গুণ ছিল। কিন্তু সে নিজেকে সামলাতে পারেনি। অনেকে ভালো কাজ করার একপর্যায়ে নিজেকে সংগঠন থেকে বড় মনে করা শুরু করে। তখনই সে এ ধরনের ভুল করে। রনির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রনি যে অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে সেটি সে নিজে স্বীকার করেছে। তাই তার ব্যক্তিগত এই অপরাধের দায়ভার আমরা নেবো না।’

খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় সংগঠন নেবে না। আমরাও তো মানুষ, আমাদের মাঝে লোভ, ক্ষোভ, ঘৃণা, বিদ্বেষ থাকতে পারে। কেউ যদি সংগঠনের কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে কোনও ঝামেলায় পড়ে, তখন সংগঠন হয়তো তার দায় নেবে। এর বাইরে কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় আমরা নেবো না।’চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ জাহেদ খানের ওপর চড়াও হন রনি

মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনাগুলো ঘটার পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ ছিল। ওই কারণগুলো সে যথাসময়ে মানুষের সামনে আনতে পারেনি। অথবা আনা গেলেও কাজে আসেনি। তবে যেহেতু মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল, সুতরাং তার আরও ধৈর্যশীল হওয়া উচিত ছিল। সে যদি টাকা পায়, সেটা নেবে। কিন্তু টাকা আদায়ের তো আরও কিছু প্রক্রিয়া ছিল। তার (রনি) সেগুলো অবলম্বন করা উচিত ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনহিতকর কর্মকাণ্ডের কারণে সে মানুষের কাছ থেকে যে ধরনের প্রশংসা পেয়েছিল, তার উচিত ছিল সে অনুযায়ী নিজেকে পরিচালনা করা। সেটি সে করতে পারেনি।’ মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ায় কিছুটা হলেও তার (রনি) পদস্খলন হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘রাজনৈতিক জীবনে সব মানুষের একজন অভিভাবক প্রয়োজন। রনির অভিভাবক ছিলেন সদ্য প্রয়াত মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। মহিউদ্দিন চৌধুরী নেতাকর্মীদের ডেকে নিয়ে রাজনীতিতে কী করা উচিত, কী করা উচিত না এসব বিষয়ে কাউন্সিলিং করতেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাওয়ার পর রনিকে ডেকে নিয়ে কেউ এ ধরনের পরামর্শ দেননি অথবা এ ধরনের কোনও পরামর্শ পাননি। তার এই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পেছনে অনেক কারণের মধ্যে এটি একটি কারণ।’

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ১৩ জুন ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সংসদ। কমিটি ঘোষণার পর থেকে সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা পান রনি। শিক্ষা আন্দোলন নামে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রলীগের এই নেতা সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের প্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। তার প্রতিবাদের মুখে চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল কলেজ অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ করে। সম্প্রতি ওই আন্দোলনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিতর্কিত হন তিনি।

উন্নয়ন ফি আদায়ের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ কর্তৃক নেওয়া অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা ফি ফেরত নিতে গিয়ে গত ৩১ মার্চ ওই কলেজের অধ্যক্ষ জাহেদ খানকে কিল ঘুষি মারেন নুরুল আজিম রনি। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ জাহেদ খান তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে বৃহস্পতিবার (১৯ এপ্রিল)  মারধরের অভিযোগ এনে রনির বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন নগরীর জিইসি মোড়ের ইউনিএইড কোচিং সেন্টারের মালিক রাশেদ মিয়া। অভিযোগে তিনি বলেন, রনি তার কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ওই টাকা না দেওয়ায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নগরীর জিইসি এলাকায় ইউনিএইড কোচিং সেন্টারে রাশেদের কক্ষে তাকে মারধর করেন রনি। এরপর গত ১৩ মার্চ একই দাবিতে রাশেদ মিয়াকে তুলে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় মারধর করা হয়। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।

আরও পড়ুন- 

চাঁদার দাবিতে কোচিং সেন্টার মালিককে থাপ্পড়, ছাত্রলীগ নেতা রনিকে অব্যাহতি (ভিডিও)

চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষকে ছাত্রলীগ নেতার কিল-ঘুষি (ভিডিও)