‘এই বাড়ির কোনও ছবি তুলবেন না’

 

কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের বাড়ি

ফেনী সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের বাড়ি এখন নিস্তব্ধ। রায়ের পর শনিবার (২৬ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা যায়, পৌর শহরের জিরো পয়েন্টের এই বাড়ির সদর দরজা বন্ধ। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাড়ি হিসেবে এতোদিন ভিড় লেগে থাকলেও এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে।

শনিবার দুপুরে বাড়ির সামনে গিয়ে তিনজনকে কথা বলতে দেখা যায়। এসময় মাকসুদের ছোট ভাই মাইন উদ্দিন রুবেল বলেন, ‘আমরা আর কী বলব? যা হবার হইছে! এখন উচ্চ আদালতে যাব। এই বাড়ি আমাদের যৌথ। বাড়ির কোনও ছবি তুলবেন না। আমাদের আর কিছু বলার নেই। আপনি যান।’

কে এই মাকসুদ?

মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর একসময় সবজি বিক্রেতা হিসাবে ব্যবসা করতেন। আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে বিনা ভোটে সোনাগাজী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হন। এরপর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান। নুসরাত হত্যার মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ তাকে মাদ্রাসার গভানিং বডির সদস্য করে নেন।

নুসরাত হত্যায় মাকসুদের ভূমিকা কী?

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দায়েল করা মামলার ৪ নম্বর আসামি মাকসুদ। নুসরাতকে যৌন হয়রানি মামলায় ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলার গ্রেফতার হন। এই ঘটনার পর ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন মাকসুদ আলম। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন তিনি। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন তিনি।

দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিদের বাড়িতেও নীরবতা

শাহদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, এমরান হোসেন মামুন ও মনিসহ অপর দণ্ডিতদের বাড়িতেও নীরবতা দেখা গেছে ।  

শাহদাত হোসেন শামীমের বাড়ি উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের ভূঞার হাট এলাকায় প্রবেশের সময় কয়েকজন লোক বলছিলেন, ‘সাংবাদিক আবার কেন আসছে? কোনও ছবি না তোলার শর্তে তাদের একজন বাড়ির ভেতরে যেতে অনুমতি দেন। বাড়ির ফটক পেরোতেই দেখা যায়- বাড়ির ভেতরে দলবদ্ধভাবে বেশ কয়েকজন নারী-শিশু দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লেন। ওই বাড়িতে আরও মানুষ ছিলেন। তবে কারও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।’

এই মামলায় অপর দণ্ডিত আসামি নুসরাতের সহপাঠী কামরুন নাহার মনির সোনাগাজী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মনির মা কাঁদছেন। মনির স্বামী রাশেদ খান রাজুর বিশ্বাস, তার স্ত্রী এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন না। হাইকোর্টে আপিল করলে তারা ন্যায় বিচার পাবেন।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নুর উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে তার পিতাকে।

অপর দণ্ডিত সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িও নীরব।

জোবায়েরের পিতা রহমত উল্যাহ বলেন, ‘এখন আর কী করবো? যা হওয়ার হয়ে গেছে।’

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রভাষক আবছার উদ্দিন, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম,  মহিউদ্দিন শাকিল, হাফেজ আব্দুল কাদেরের বাড়িতে গিয়েও দেখা যায়-  বাড়ির মধ্যেই রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর  কেউ কোনও কথা বলতে রাজি হননি।


নুসরাতকে পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নেওয়া উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা ওরফে শম্পার বাড়ি ডাকবাংলো এলাকায় গিয়ে জানা যায়, এই রায়ের পর কী করবেন তা  ভেবে পাচ্ছেন না পরিবার। এই পরি সিরাজ-উদ-দৌলার আপন ভাগ্নি।
উল্লেখ্য, ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। চারদিন অসহ্য যন্ত্রণার পর ১০ এপ্রিল নুসরাত মারা যান। এই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের পর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই)। ২৪ অক্টোবর তাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। একই সঙ্গে সব আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দিতে বলা হয়।