কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একটি উগ্রবাদি সন্ত্রাসী গ্রুপ কেরোসিন ও পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পরিষ্কার করে বলা যাবে।
গত সোমবার (২৩ মার্চ) দুপুরে বালুখালীর ৮ ও ৯ নম্বর ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুনে ৯ হাজার ৩শ’ পরিবারের ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়স্থল হারিয়েছেন। পুড়ে গেছে দোকানপাট ও বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে বসবাসরত বাংলাদেশি দুই শতাধিক পরিবারের বাড়িঘরও পুড়ে ধ্বংস হয়েছে।
তবে ভয়াবহ এই আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি স্থানীয় প্রশাসন। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, ক্যাম্পের উগ্রবাদি ও সন্ত্রাসী একটি গ্রুপের সঙ্গে অপর গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারা জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ব্যাঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে অরাজকতা সৃষ্টি এবং ক্যাম্পে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগানো হয়েছে।
ওই এলাকার অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক জানান, ‘আগুনের ঘটনা রহস্যজনক। কারণ, ক্যাম্পে স্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে একসঙ্গে কয়েকটি জায়গায় কীভাবে আগুন জ্বলে উঠলো? বিভিন্ন জায়গায় একই সময়ে আগুনের ঘটনা কোনোক্রমেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। এছাড়াও ক্যাম্পের ভেতরে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশি অনেক পরিবারে সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আমাকে বলেছেন, ক্যাম্পে একশ’ ফুট দূরত্বের মধ্যে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠায় তারা অতঙ্কিত।’
মোহাম্মদ শাহাজাহান নামের স্থানীয় অপর যুবক বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ ও ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া তুলে নিতে পুরো ক্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা। ক্যাম্পের ভিতরে একটি উগ্রবাদি গ্রুপ মনে করে সেখানে শুধু তাদের কর্তৃত্ব থাকবে। কোনও ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে না। এছাড়া কোনও রোহিঙ্গাকে আগুন নেভাতে দেখা যায়নি।’
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারাই ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে শুনেছি। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা দুই গ্রুপে বিভক্ত। এদের মধ্যে একটি গ্রুপ অস্ত্রধারী, অপর গ্রুপ নিরীহ। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে চায় না। তাই তারা বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নস্যাৎ করতে চায়।’ তিনি দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এসব সশস্ত্র রোহিঙ্গার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
অপরদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চাপাক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয় গ্রামবাসী ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’। সাধারণ রোহিঙ্গাদের অনেকেই বলছেন, এ ঘটনা আত্মঘাতী। তবে এসব রোহিঙ্গা এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি। যারা এ ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তারা ক্যাম্পটিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। তাদের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলতে পারছে না। সাধারণ রোহিঙ্গাদের এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা জিম্মি করে রেখেছে।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের সময় সেখানে বিস্ফোরকের গন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি দাহ্য পদার্থের আগুনের ফুলকি ছুটে যাওয়ার মতো ঘটনাও সেসময় ঘটেছে বলে রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। যদিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যবহার করা গ্যাস সিলিন্ডার ছিল এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে আগুনের ব্যাপকতা দ্রুত ছড়িয়েও পড়তে পারে। তবে যে গন্ধ এ সময় পাওয়া গেছে তা গ্যাস সিলিন্ডারের নয়; বরং বিস্ফোরকের গন্ধ বলেই রোহিঙ্গাদের ধারণা। সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান, সশস্ত্র রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কেমিক্যাল নিয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন প্রেস ব্রিফিং করেন। এ সময় তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। তবে তিনি এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তদন্ত কমিটি এসব বিষয় দেখবে বলে জানান তিনি। সচিব এ সময় বলেন, ‘ক্যাম্পে অগুনের সূত্র এখনও অজানা। এ ঘটনার কারণ জানতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি আগামী তিন কার্যাদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। আমরা বিশ্বাস করি, সত্যিকারের বিষয়টি খুব দ্রুত বের হয়ে যাবে।’