ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এক বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আবু ইউসুফ ওরফে লিমন (২১)। মিরপুরের সিটিক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ নিতেন তিনি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নিখোঁজ হন। খোঁজ না পেয়ে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি কচুয়া থানায় ডায়েরি করেন তার বাবা। কিছুদিন পর জানতে পারেন একটি হত্যা মামলায় তার ছেলে লিমন কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন। ওই মামলার ৬ নম্বর আসামি ছিল রবিউল ইসলাম ওরফে আপন নামের একজন। নানা হুমকি-ধমকিতে তার পরিবর্তে বাধ্য হয়ে আসামি হিসেবে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন লিমন। এ ঘটনায় দ্রুত ‘নিরপরাধ’ সন্তানের মুক্তি চায় তার পরিবার।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে গাজীপুরে খুন হন পুলিশের সিআইডিতে কর্মরত উপপরিদর্শক মামুন ইমরান খান। ঘাতকরা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। তার মরদেহ গজারির বন থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। সেই ঘটনায় ওই বছরের অক্টোবরে মামলা হলে পরের বছর আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। ওই মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের প্ররোচনায় নিজের পরিচয় গোপন করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন নিরীহ যুবক আবু ইউসুফ লিমন। তারপর থেকে গত ৭ মাস ধরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি লিমন। কিন্তু এরপর থেকে প্রতারক রবিউল ইসলাম ওরফে আপনকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব দাবি করেছেন ভুক্তভোগীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম সরদার।
লিমনের বোন আয়েশা আক্তার লিজা বলেন, ‘আমার ভাই কুমিল্লার ঠাকুরপাড়া মেটসে পড়ালেখা করতেন। সিটিক্লাবে ক্রিকেট খেলার সূত্র ধরে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। আমার ভাইকে তারা ঢাকায় ছুরি, বন্দুক দেখিয়ে অপহরণ করে। পরে ক্রসফায়ার এবং বোনকে তুলে হত্যার হুমকি দেওয়ায় ভাই আদালতে হাজির হতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে দেড় মাসের মধ্যে বের করে নেওয়ারও আশ্বাস তারা দেয়।’ তিনি জানান, আসামি রবিউল ইসলাম আপন এখন বিদেশে অবস্থান করছে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, আসামি রবিউল ইসলাম আপন গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার আসুতিয়া গ্রামের মতিউর রহমান মোল্লার ছেলে। নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিতো রবিউল ও তার সহযোগীরা। তাদের কবলে পড়েন সিআইডি পুলিশের এসআই মো. মামুন ইমরান খান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুর বনে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। এ ঘটনায় নিহত এসআইয়ের ভাই বাদী হয়ে ঢাকার বনানী থানায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই মামলা করেন। এই মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এরপর ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয় মামলাটির। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। একই মামলার ৬ নম্বর আসামি হলো রবিউল ইসলাম ওরফে আপন।সে পলাতক রয়েছে। কিন্তু তার পরিবর্তে রবিউল সেজে চাঁদপুরের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান আবু ইউসুফ লিমন গত ২০ অক্টোবর ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। রবিউলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তিনটি মামলা রয়েছে। সে সব মামলাও বর্তমানে বিচারাধীন।
আবু ইউসুফের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম সরদার জানান, আবু ইউসুফ ওরফে লিমনের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আইনপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মো. নুরুজ্জামান। এক ভাই এক বোনের মধ্যে সে বড়। পিতা নুরুজ্জামান কচুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ছোটবেলা থেকেই ইউসুফের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। সেই সূত্র ধরেই ইউসুফ রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে এক মেসে ভাড়া থাকতেন। ছোটখাটো কাজ করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সিটি ক্লাবে কোচ সবুজের অধীনে ক্রিকেট খেলা শিখতেন। সেখান থেকে আসামি রবিউলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ইউসুফের। আবু ইউসুফ ওরফে লিমন আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে হৃদয়ের জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছে। তাকে তারা রবিউলের জায়গায় না গেলে নিহত পুলিশ কর্মকর্তার মতো হত্যা করে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেবে—এমন ভয়ভীতি দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করিয়েছে।