শূন্যরেখায় আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্ন জীবন

এ পাশে খাল, ও পাশে কাঁটাতারের বেড়া, মাঝখানে নো-ম্যানস ল্যান্ড। এই স্থানটি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়ক থেকে পূর্ব দিকে চার কিলোমিটার দূরে পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় অবস্থিত। জায়গাটির নাম তুমব্রু, রোহিঙ্গা ভাষায় তুমব্রু রাইট বা কোনাপাড়া। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢোকার সময় কিছু লোক আটকা পড়ে এই নো-ম্যানস ল্যান্ডে। সেখানে বর্তমানে ৬শ’ ২২ পরিবারের চার হাজার ৩৩ জন রোহিঙ্গার একটি শিবির। দুই বছর আগে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার জন।

সরেজমিন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের এ পাশে কোনাপাড়ায় ঢুকতে দেখা যায় কিছু বিজিবি সদস্য ও দাতা সংস্থার কর্মীরা ছাউনির ঘরে বসে গল্প করছেন। তাদের পাশে খেলা করছিল একঝাঁক রোহিঙ্গা শিশু। যে-যার মতো মাটিতে খেলছে। একটু পাশে শূন্যরেখার এ পাশে মাঠে ক্রিকেট খেলছিল স্থানীয় স্কুল পড়ুয়ারা। এই চিত্র দেখে একটু অবাক লাগছিল। কারণ এক বছর আগে সেখানে মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাবাহিনীর ভয়ে কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, আশপাশেও থাকা মুশকিল ছিল। এখন নো-ম্যানস ল্যান্ডের দৃশ্য বদলে গেছে। তবে বদলায়নি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তু হয়ে আসা শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের জীবন।

IMG20210814163928শূন্যরেখা শিবির থেকে খাল পেরিয়ে এ পাশে খেলায় অংশ নিতে আসে মোহাম্মদ রফিক (১০) নামে এক শিশু। রফিক বলে, ‘ভাটার সময় খালে পানি কমে গেলে এ কূলে এসে সময় পার করি। বিকালবেলায় ফিরে যাই শূন্যরেখায়। কক্সবাজারের আশ্রিত শিবিরের শিশুদের জন্য খেলাধুলার জায়গা এবং সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এখানে আমাদের জন্য কিছু নেই। একসময় ও কূল থেকে মিয়ানমার বিজিপি গুলি এবং ইটপাটকেল ছুড়লেও এখন তেমন ঘটনা ঘটে না, তাই ভয়টাও কমে গেছে।’ কিন্তু শূন্যরেখায় শূন্য হয়ে আছে তারা। এ কূল-ও কূল কোনোটাই নেই তাদের। ঘোরাফেরায়ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাদের।

শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা জানান, শুরুতে বান্দরবানের তুমব্রু খালের কাছে শূন্যরেখায় প্রায় এক হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা পরিবারের প্রায় ছয় হাজার মানুষ ছিল। বর্তমানে এখানে ৬শ’র বেশি পরিবারের চার হাজার ৩৩ জন মানুষের বসতি। এছাড়া গত চার বছরে সেখানে ২শ’ শিশু জন্ম নেয়। উখিয়া ও টেকনাফের অন্য ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাগরিক সুবিধা থাকলেও এখানে তেমন কিছুই নেই। রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেড়শ’র মতো এনজিও কাজ করলেও এদিকে কারও নজর নেই। তবে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস (আইসিআরসি) প্রতি মাসে দু’বার করে নো-ম্যানস ল্যান্ডে ত্রাণ এবং সপ্তাহে পাঁচ দিন করে অস্থায়ী ক্যাম্প করে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।

IMG20210814165445‘চারটি বছর পেরিয়ে গেলো নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ উল্লেখ করে রোহিঙ্গা সৈয়দ আলম (৪৩) বলেন, ‘এখানে কোনোমতে জীবন চলছে। নেই তেমন কোনও সুযোগ-সুবিধা।  বর্ষার সময় এখানে লোকজনকে খুবই কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়। গত বর্ষার সময় ভেঙে যাওয়া ঘরগুলো নিজেদের মেরামত করতে হয়েছে। এসবের জন্য কেউ এখানে সহায়তা করে না। একটিমাত্র এনজিও ত্রাণ বিতরণ করে এখানে। যতটুকু ত্রাণ পাই, তা নিয়ে সংসার কোনোমতে চলে। এখানে একটি টয়লেটও নারীদের ব্যবহারোপযোগী নয়।’ তবে এসব সমস্যা ছাপিয়ে তাদের মূল আক্ষেপ দেশে ফিরতে না পারা।

এ বিষয়ে শূন্যরেখা রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘এখানে চার বছর পেরিয়ে গেলো। কিন্তু কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না। কূলহীন মানুষের জীবন আর কত ভালো হতে পারে! আমরা বাংলাদেশে আর ঢুকতে চাই না, নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে চাই।’

আশ্রয় নেওয়ার সময়েই এখানে ২শ’ শিশু জন্ম নেয় জানিয়ে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘আমাদের জীবন তো অন্ধকারেই ফুরিয়ে গেলো। কিন্তু এই শিশুদের জীবনও কি তেমন হবে? অন্য শরণার্থী শিবিরের মতো ত্রাণ এখানে পৌঁছায় না। নেই পর্যাপ্ত খাবার পানি, নেই টয়লেট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। বিশেষ করে এখানকার শিশুদের জীবন শূন্য হয়ে আছে।’

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে তাদের নিজ দেশে ফেরানো। রোহিঙ্গাদের বসবাসের কারণে দিন দিন তার এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি  হচ্ছে।