নালায় ডুবে মরছে মানুষ, নির্বিকার সিটি করপোরেশন

নালার পানি ও ময়লায় ডুবে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না। সর্বশেষ নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুসহ গত তিন মাসে উন্মুক্ত নালা ও খালে পড়ে চট্টগ্রামে মারা গেছেন পাঁচ জন। নগরবাসীর অভিযোগ, একের এক এমন মৃত্যুর ঘটনার পরেও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।

নালার ওপর স্ল্যাব না থাকা, খাল-নালা নিয়মিত পরিষ্কার না করাসহ পর্যাপ্ত সড়কবাতির অভাবে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তবে এসব কাজের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংস্থা সিটি করপোরেশনের যেন কোনও মাথাব্যথা নেই। তারা নালা-খালে ডুবে মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চলমান প্রকল্পগুলোর কারণেই নাকি এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি সিটি করপোরেশনের। 

সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সেহেরিন মাহবুব সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মেয়র। তখন তিনি আরও বলেন, আধুনিক নগর গড়তে উন্নয়ন করতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেই করুক, এ কারণে নাগরিক দুর্ভোগ ও ভোগান্তি হবে এটা প্রত্যাশিত না। চট্টগ্রাম নগরীতে করপোরেশনসহ যেসব সেবা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন কাজ করছে, তাদের সবার মধ্যে সমন্বয় না হলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।

তবে সিটি মেয়রের দায় এড়ানোর এমন বক্তব্য ভালোভাবে নিচ্ছেন না নগরবাসী। তারা বলছেন, একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে সিটি করপোরেশনের মেয়র এভাবে দায় এড়ানোর কথা বলতে পারেন না। এর আগে, এক ব্যবসায়ী নালায় পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনায়ও তিনি এভাবে দায় এড়িয়ে যান। সিটি করপোরেশন খাল-নালাগুলো ঠিকভাবে পরিষ্কার করলে নালায় ডুবে কারও মৃত্যু হতো না। 

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের মোবাইলফোনে একাধিকবার কল করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামসকে কল করা হলে তিনিও তা রিসিভ করেননি।

তবে ঘটনার পর মঙ্গলবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিটি মেয়র যে বলেছেন-সিডিএর কারণে এমন হয়েছে, এটি সঠিক নয়। এখানে সিডিএর কোনও দোষ নেই। খাল, নালাগুলো দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তারা যদি খাল নালার ওপর স্ল্যাব না দেয় আমরা কী করবো, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৯৪৬ কিলোমিটার নালা রয়েছে। এছাড়া নগরীর আওতাধীন ৫৭টি খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬১টি কিলোমিটার। এই ৯৪৬ কিলোমিটার নালার কী পরিমাণ খোলা আছে তার কোনও তথ্য নেই সিটি করপোরেশনের কাছে। তবে নগরীর অধিকাংশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের চলাচল পথের পাশে অধিকাংশ নালার ওপর কোনও স্ল্যাব নেই। বৃষ্টির সময় নগরী পানিতে তলিয়ে গেলে কোথায় ফুটপাত, কোথায় নালা আর কোথায় সড়ক তা বোঝার কোনও উপায় থাকে না।

নালায় ডুবে মারা যান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সেহেরিনএদিকে নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েই নালার ওপর স্ল্যাব না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। গেল সপ্তাহে চাক্তাই এলাকায় নালায় পড়ে মারা যান এক ভবঘুরে। এর আগে ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে গত ২৫ আগস্ট সকালে মুরাদপুর এলাকায় খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি। 

অন্যদিকে ৫৭টি খালের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেও নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। যে কারণে নালা ও খালে ডুবে মরছে মানুষ। চলতি বছরের ৩০ জুন নগরীর ষোলশহর এলাকায় চশমা হিল খালের পাশের সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় সিঁড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশা খালে পড়ে যায়। স্রোত থাকায় খালে পড়ে তলিয়ে মারা যান অটোরিকশা চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)। 

সর্বশেষ সোমবার রাত ১০টায় নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় নালায় পড়ে মারা যান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেহেরিন মাহবুব সাদিয়া। নালায় পড়ে যাওয়ার ৫ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে ৩০ গজ ভেতর থেকে তাকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, সাদিয়া যেখানে পড়ে যান, সেই নালা ১৫ ফুট গভীর ও প্রচুর আবর্জনায় ভরা ছিল। প্রায় তিন-চার টন আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের গত তিন মাসের ব্যবধানে খাল-নালায় ডুবে পাঁচ জন প্রাণ হারালেও এ সময়ে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।